আদব নং—১০
তিলাওয়াতের সময় ক্রন্দন করা
কুরআন তেলাওয়াতের সময় (আজাবের আয়াত এলে) কাঁদা মুস্তাহাব। কান্না না আসলে কান্নার ভান করবে। অন্তরের দুঃখ— অনুশোচনা কিংবা আনন্দ—কোমলতা প্রকাশ করাটাই যুক্তিযুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
اَللهُ نَزَّلَ اَحْسَنَ الْحَدِيْثِ كِتَابًا مُّتَشَابِهَا مَثَانِىَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُوْدُ الَّذِيْنَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِيْنُ جُلُوْدُهُمْ وَقُلُوْبُهُم اِلٰى ذِكْرِ اللهِ
‘আল্লাহ উত্তম বাণী তথা কিতাব নাজিল করেছেন, যা সামঞ্জস্যপূর্ণ, বারবার পঠিত। এতে তাদের লোম কাঁটা দিয়ে উঠে চামড়ার উপর, যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে। এরপর তাদের দেহ ও অন্তর আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়।’ —সূরা যুমার, আয়াত : ২২
اَنْ يَّبْكُوْنَ وَيَزِيْدُهُمْ خُشُوْعًا
‘আর তারা চিবুকের ওপর পতিত হয় কাঁদতে কাঁদতে, আর কুরআন তাদের নম্রভাবকে আরো বৃদ্ধি করে দেয়।’ —সূরা ইসরা, আয়াত : ১০৯
لَوْ اَنْزَلْنَا هٰذَا الْقُرْاٰنَ عَلٰى جَبَلٍ لَّرَأَيْتَهٗ خَاشِعًا مُّتَصَدِّعًا مِّنْ خَشْيَةِ اللهِ
‘যদি আমি এই কুরআনকে কোনো পর্বতের ওপর নাজিল করতাম তবে তুমি তাকে দেখতে পেতে আল্লাহর ভয়ে বিনয়াবত ও বিদীর্ণ হয়ে গেছে।’ —সূরা হাশর, আয়াত : ২১
পাহাড়ের মতো প্রচণ্ড শক্তিশালী ও নির্বাক জিনিসও যদি আল্লাহর ভয়ে বিধ্বস্ত ও বিদীর্ণ হয়ে যায়, তাহলে কুরআনের প্রভাবে মানবাত্মা প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রভাবান্বিত হওয়াটা অধিক উপযুক্ত। এটা তো অত্যন্ত দুঃখজনক কথা যে, অন্তর পাহাড়ের চেয়েও অধিক শক্ত হয়ে গেছে।
বুখারী ও মুসলিম শরীফের রেওয়ায়াত-
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ قَالَ قَالَ لِىْ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِقْرَأْ عَلَىَّ، قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ آقْرَأُ عَلَيْكَ وَعَلَيْكَ اُنْزِلَ؟ قَالَ نَعَمْ. فَقَرْأْتُ سُوْرَةَ النِّسَاءِ حَتّٰى اَتَيْتُ اِلٰى هٰذِهِ الْاٰيَةِ ﴿فَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا مِنْ كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهِيدٍ وَجِئْنَا بِكَ عَلَى هَؤُلَاءِ شَهِيدًا﴾ قَالَ حَسْبُكَ الْاٰنَ فَالْتَفَتُّ اِلَيْهِ فَاِذًا عَيْنَاهُ تَذْرِفَانِ
‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন ‘আমাকে তিলাওয়াত করে শুনাও’! আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনাকে তিলাওয়াত শুনাব, অথচ আপনার উপর এটি অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি বললেন, আমি অন্যের তিলাওয়াত শুনতে পছন্দ করি। অতঃপর আমি তাকে সূরা নিসা তিলাওয়াত করে শুনাতে লাগলাম। যখন আমি এই আয়াতেفَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا مِنْ كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهِيدٍ وَجِئْنَا بِكَ عَلَى هَؤُلَاءِ شَهِيدًا (আর তখন কি অবস্থা দাঁড়াবে, যখন আমি ডেকে আনব প্রতিটি উম্মতের মধ্য থেকে অবস্থা বর্ণনাকারী এবং আপনাকে ডাকব তাদের উপর অবস্থা বর্ণনাকারীরূপে) পেঁৗছলাম; তিনি বললেন, থামো! আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাঁর চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রম্ন প্রবাহিত হচ্ছে।’—বুখারী শরীফ, খণ্ড ২, পৃ. ৭৫৫
সুনানে ইবনে মাজাহ—তে হযরত সাঈদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাযি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একথা বলতে শুনেছি যে-
اِنَّ هٰذَا الْقُرْاٰنَ نَزَّلَ بِحُزْنٍ فَاِذَا قَرَأْتُمُوْهُ فَابْكُوْا فَاِنْ لَمْ تَبْكُوْا فَتَبَاكُوْا، وَتَغَنَّوْا بِه فَمَنْ لَّمْ يَتَغَنَّ بِالْقُرْاٰنِ فَلَيْسَ مِنَّا
‘নিশ্চয় এ কুরআন মনোবেদনা সহকারে অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমরা তিলাওয়াতের সময় কাঁদো। যদি কান্না না আসে তাহলে কান্নার ভান করো। এবং শ্রম্নতিমধুর সুরে তিলাওয়াত করো। আর যে শ্রম্নতিমধুর সুরে তিলাওয়াত করে না সে আমাদের অন্তভুর্ক্ত নয়। ’
কান্না আসার পদ্ধতি হল— ধমক, কঠিন শাস্তির ওয়াদা ও আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার সম্পর্কিত আয়াত তিলাওয়াতের সময় অন্তরে এই চিন্তা ও ধ্যান করবে যে, এগুলোতে আমার থেকে কতোইনা ত্রুটি— বিচ্যুতি হচ্ছে, (যদি আল্লাহ তা‘আলা আমাকে পাকড়াও করেন, তবে আমার কী উপায় হবে? কঠিন শাস্তির উপযুক্ত হলে আমি কি তা সহ্য করতে পারব?)
এ চিন্তার পরও যদি কারো কান্না না আসে, তাহলে তার উচিত হল— নিজের বদনসীবী ও হতভাগ্যের উপর অশ্রম্নপাত করা।
মনে রাখতে হবে, কান্না বা কান্নার ভান করার দ্বারা উদ্দেশ্য হল, হৃদয়ের বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ; লৌকিকতা, কপটতা ও কৃত্রিমতা নয়। আল্লাহর ভয় ও শাস্তির আতঙ্কের কারণে অশ্রম্ন প্রবাহিত করা প্রশংসনীয়। তেমনি যে ভান করার দ্বারা অন্তর বিগলিত হয় ও মনে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হয় সেটাই কাম্য। নতুবা রিয়া—লৌকিকতার দ্বারা সওয়াবের পরিবর্তে গোনাহ হবে।