আদর্শ সমাজের সন্ধানে

আদর্শ সমাজের সন্ধানে | আবুল হাসান আলী নদভী Search of Ideal Society

অধিকার ও মর্যাদা নবীদের কাহিনী পরিবার ও গোষ্ঠি প্রবন্ধ

আদর্শ সমাজের সন্ধানে

সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী

আজ এমন একটি সমাজের বড় প্রয়োজন, যে সমাজটি হবে মানবতার বিমূর্ত প্রতীক। আল্লাহ্র সন্তুষ্টি হবে যে সমাজের পরিচালিকা শক্তি। ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস, শিক্ষা-সংস্কৃতি, জীবনের সর্বত্র স্বচ্ছ বিধৌত চরিত্রের এক সমুজ্জ্বল দর্পণ হবে যে সমাজ। এমন একটি সমাজেরই আজ বড় অভাব। আমি একথা বলছি না, এমন সুন্দর সমাজ আজ কোথাও নেই। আর এমনটি বলবই বা কি করে। তবে এমন একটি সমাজের যে প্রচণ্ড প্রয়োজন, বাস্তবেই যে এমন একটি সমাজ একান্ত জরুরী আমি সে কথাই বলছি। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিকে আমূল বদলে দিতে পারে কাঙিক্ষত সেই সমাজ। এমনটি পারবে না আর অন্য কিছু।

ইসলামের সম্মুখপথ আজ বড় বন্ধুর, রক্তপিচ্ছিল। অথচ সকলেরই জানা সেই বন্ধুর পথ মাড়িয়েই বিজয়ের লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল ইসলাম। মহান আল্লাহ্ তা’আলার অপার মেহেরবানীর স্পর্শে অর্জিত সেই বিশাল বিজয়ের ইতিহাস অনন্তকাল বিস্ময়াবিষ্ট-হতচকিত করবে সকল ইতিহাসবিদ, গবেষক ও সমালোচক গোষ্ঠীকে।

প্রশ্ন হলো, ইসলাম কিভাবে মানবজীবনের এ সুন্দরতম দৃষ্টান্ত আবিষ্কার করল? কিভাবে জন্ম দিল এমন এক সমাজ ব্যবস্থার, যার আকর্ষণে বিমোহিত শত গোষ্ঠী, শত জাতি; হৃদয়-বিবেক সমভাবে আকৃষ্ট যে সমাজের প্রতি; প্রবৃত্তি-আত্মা উৎসর্গ যে সমাজ সৌন্দর্যের তরে । সংখ্যায় ও মানে এর কোন নমুনা ইতিহাসে আছে কি? নেই। নিশ্চয় নেই।

অতীতে ইসলাম সমাজচিত্রের যে আদর্শ স্থাপন করেছে আগামীতে তা আর পারবে না। সেই শীর্ষবিন্দু আর স্পর্শ করতে পারবে না যেখানে কদম রেখেছিল এক সময়। বরং অতীত দিনের সেই বাস্তবতা অনন্তকাল স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকবে। ইসলামের সে সমাজ জীবন তো ছিল এক জীবন্ত বাস্তবতা। পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছে। সশব্দ কথা বলেছে। হাত-পা নেড়ে চলাফেরা করেছে। সে সমাজে বাস্তবতা উপলব্ধি করেছে সেকালের প্রতিটি মানুষ। সে সমাজে সৌন্দর্য বিমোহিত হয়েছিল প্রতিটি প্রাণী। ইতিহাসের মহাসমুদ্রে সে এক স্থিতিশীল বাতিঘর।

এ সমাজের প্রতীক্ষা ছিল হাজার বছরের। যুগ যুগ ধরে ছিল এর প্রত্যাশা। মানুষ এমন সমাজের চিত্র খুঁজে পেত না কোথাও। এক সময় আসমানী কিতাবগুলোতে সেই চরিত্রের কথা ছিল। সভ্যতা ও আদর্শের সবক ছিল। কালক্রমে ওতেও ওলট-পালট হলো অনেক। রদ-বদল ও বিকৃত হয়ে হলো দর্শনের অবহেলিত ভাণ্ডার। শ্বাসরুদ্ধকর সেই কিতাবী সবকে মুক্ত মনে বাঁচার সন্ধান পেল না মানুষ সেখানে পেল না তারা ঈমানের সুবাস। স্বচ্ছ অনুভব, উষ্ণ আবেদনের কোন স্পর্শই পেল না সে কিতাবে। হৃদয়ের খোরাক, সৌভাগ্যের সওদা বলতে যা কিছু ছিল সবই হারিয়ে গেছে অজানা হস্তক্ষেপে। আসমানী কিতাব খুলে তারা পড়ত। কিন্তু জাগরণ সৃষ্টি হতো না অনুভবে। অথচ মানুষের অনুসন্ধিৎসা ছিল এমন একটি সমাজের, যার ছোঁয়ায় ঈমানের গন্ধ আছে। তরতাজা গন্ধ। যে সমাজের চাল-চিত্র বলে দেয় বেহেশতের শুভ সংবাদ । এখানে এলেই যে কেউ অনুমান করে কল্যাণের অকৃত্রিম স্বাদ। মনে হয় জীবন চলেছে এক অনন্ত শান্তির দিকে।

এমন একটি সমাজের বিনির্মাতাই হলেন হযরত মুহাম্মদ (সা)। এ সমাজের প্রথম কেন্দ্র ছিল মদীনা মুনাওয়ারা। তারপর এগিয়েছে এক পা দু’পা করে। অনন্তর পৃথিবীর দিগন্ত স্পর্শ করেছে। পদদলিত করেছে দেশের পর দেশ। সে এক অপূর্ব জীবনদর্শন! হৃদয় টেনে নেয়। চেতনা-বিশ্বাস আকৃষ্ট করে। স্বরূপে বয়ে চলে বিবেক-বুদ্ধিকে প্লাবিত করে। এ সমাজের প্রতিটি উচ্চারণই যেন প্রমাণসিদ্ধ। দলিল যেন কথা বলে সকল ক্রিয়াকাজে।

এই সমাজে ছিল কিছু মানুষ। তারাই ছিল এসব গুণের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। সাক্ষাৎ নমুনা। একজন ভিন্ন পরিবেশের মানুষ যখন এখানে আসত, প্রভাবিত হতো। আকৃষ্ট হতো। তার হৃদয়-বদন আকর্ষিত হত সমভাবে। প্রীত হতো এই সমাজের ভালোবাসায়। ছেড়ে যেতে চাইত না আর। জীবন-মরণ সঁপে দিতে চাইত সেই সমাজের তরে। থাকতে চাইত সেখানে আমরণ।

বিশিষ্ট তাবিঈ ইব্‌ন শিহাব যুহরী (র) বলেনঃ “পরিবেশ যখন শান্ত হলো, বিদায় নিল যখন যুদ্ধ-বিগ্রহ, সর্বত্র নেমে এলো শান্তির ছায়া। মানুষ পরস্পরে কথা বলার সুযোগ পেল। মুসলমান অমুসলমানের সাথে মত বিনিময় হলো। বাক-বিতণ্ডাও হলো। দেখা গেছে, ইসলাম সম্পর্কে যে-ই কিছু বলেছে-শুনেছে ইসলাম কবুল করেছে। অল্প দিনেই ইসলামের সামিয়ানা ভরে উঠল। দ্বিগুণ সদস্যে ভরে উঠল। বরং মানুষের ভীড় ছিল আরো বেশি।

এটা ছিল হুদায়বিয়ার সন্ধি ও মক্কা বিজয়ের মাঝামাঝি সময় কাফির মুশরিকদের অনেক আত্মীয় ছিল মুসলমান। অনেক বন্ধুজনও। হুদায়বিয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর তারা জীবনে প্রাণ খুঁজে পেল। সুযোগ পেল মুসলমান আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ করার। তারা সাক্ষাৎ করতে আসত। মাঝে মধ্যে কিছু সময় কাটাতো মুসলমান আপনজনদের সাথে। নিকট থেকে তাদেরকে দেখত তারা। কখনো আবার পুরো দিনটিই কাটিয়ে দিত তাদের সাথে।

তারা তখন মুসলমানদের মধ্যে জীবনের এক নতুন ধারা খুঁজে পেল। দেখল ওদের জীবনবোধে বিরাট পার্থক্য। ওরা যেন ভিন্ন ধাঁচের মানুষ। কোথাও প্রচ্ছন্নতা নেই। কথায় কথায় মিথ্যা বলে না। গালমন্দ পাড়ে না। রাগে-রোষে সীমা অতিক্রম করে না। নিজের উপর প্রাধান্য দেয় অন্যকে। নিজে দুর্দশাগ্রস্ত। অথচ অন্যের দুঃখ ঘুচাতে উৎসর্গপ্রাণ। নিজের সংসারে অভাবের শত ছিদ্র। তবুও অন্যের প্রতি দরাজ হাত। তারা শুয়ে-বসে-দাড়িয়ে আল্লাহকে ডাকে। কখনো ভুলে না এই জপ। সকল কাজেই তারা পরকালের প্রতিদান প্রত্যাশী। তাদের জীবনের সর্বত্র শান্ত প্রবাহ। ভাঙ্গা কুড়েঘর। তবুও যেন জান্নাতের টুকরো। জান্নাতুল ফেরদৌসের ঘর সংসার আছে। সেখানে নেই। ঝগড়া-বিবাদ। নেই গাল-মন্দ, নিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, হিংসা, সন্দেহপরায়ণতা।

তারা এই পরিচ্ছন্ন গুণাবলীর আকর্ষণে বিমোহিত হতো এবং স্বতঃস্ফূর্ত মনে ইসলাম কবুল করত।

ওরা কাফির! ওদের অনেক আত্মীয় মুসলমান। তাই ওরা বেড়াতে আসত মদীনায়। নির্বাসিত-বিতাড়িত মুসলমানদের বাড়িতে। কেউ খালার বাড়িতে, কেউ চাচার বাড়িতে । ভাগ্নের বাড়িতে আসত কেউ কেউ, আসত ভাতিজার বাড়িতে। আসা-যাওয়া রীতিমত অভ্যাস এখন। দীর্ঘদিন ধরে মুসলমান ও কাফিরদের মধ্যে সংঘাতের যে পর্দা ছিল তার যবনিকাপাত ঘটেছে। মাঝখানে এখন কোন প্রাচীর নেই। কুরাইশের কাফিররা এখন মুসলমানদের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারে। ভয় পায় না। আশংকা করে না। তাই সাক্ষাতে আসে। মাঝে মধ্যেই আসে। আত্মীয়ের কাছে আসে। বন্ধুজনদের কাছেও। তাদের সাথে কিছু সময় কাটায়। বিস্মিত হয় মুসলমানদের অবস্থা দেখে! আর ভাবে, আমরা আর মুসলমানরা তো একই বংশের মানুষ। সকলেই আমরা বনূ আদনান বর্ণ কুরাইশ। আমরা কথা বলি একই ভাষায়। আরবীতে। খাবার খাই একই ধরনের। পোশাক-পরিচ্ছদও এক। ইউনিফরম অভিন্ন। অথচ আমাদের মাঝে বিশাল ফারাক। বিস্তর ব্যবধান। কোথেকে এলো এ দুস্তর ব্যবধান। তাদের জীবন আর আমাদের জীবনের এত পার্থক্য কেন? তারা তো আকাশের ফেরেশতা। আর আমরা মাটির মানুষ। বিস্ময়ে তাজ্জবে আবেগে তারা বিমোহিত হতো। আর স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠে বলে উঠত-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্।

যত কিছুই হোক তারা তো রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পুণ্যময় বংশধর। ঈমানী রক্ত প্রবাহিত তাদের ধমনীতে। তাই তাদের স্বভাব ছিল সুস্থ। চিন্তা-ভাবনা ছিল স্বচ্ছ। ভালো-মন্দের বিচার ক্ষমতা ছিল তাদের। তারা সত্যকে মাপতে পারত। তাই তারা অনাবিলচিত্তে ঘোষণা করল ইসলামই এনেছে এই বিশাল পার্থক্য। তাদেরকে শত বৈশিষ্ট্যে ভাঙ্গুরিত করেছে ইসলাম। তা হলে আমরা কেন মেনে নেব না ইসলামকে। এভাবেই তারা আশ্রয় নিত ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে। কারণ, তারা তো দুচোখ ভরে দেখেছে ইসলামকে। দু’পায়ে চলতে দেখেছে। হ্যা, ইসলাম সেকালের মুসলমানদের কাছে কোন চিন্তা-দর্শনের বিষয় ছিল না। সূক্ষ্ম গবেষণার বিষয়ও ছিল না। ধরে ছুঁয়ে প্রত্যক্ষ বোঝার বিষয় ছিল ইসলাম।

প্রকৃতপক্ষে এমন একটি সমাজ বড় প্রয়োজন এখন। আমরা ইতিহাসে পড়েছি-সম্রাট হেরাক্লিয়াস তার এক দরবারীকে জিজ্ঞেস করেছিল : আচ্ছা বল দেখি, কি হলো-আমরা একের পর এক সৈন্যের বহর প্রেরণ করছি, কিন্তু কই কিছুই তো হচ্ছে না! অথচ আমাদের সৈন্যবাহিনী এই তো কয়দিন আগে ইরানের বিশাল সৈন্যবাহিনীকে কচুকাটা করেছে। তাদের শক্তিহিমাদ্রিকে ভেঙ্গে-চুরে খান খান করেছে। তাদের দেশে পত্পত্ করে উড়েছে আমাদের বিজয় কেতন। কিন্তু আজ কি হলো? অদূরদর্শী, অনভিজ্ঞ মুসলিম বাহিনীকে হার মানাতে পারছে না। অথচ এদের তুলনায় ইরানীরা ছিল দক্ষ, অভিজ্ঞ ও লৌহযোদ্ধা। ইরানীরা তো কুশলী যোদ্ধা। যুদ্ধের সমূহ কৌশল ওদের আয়ত্তে। তারপরও হারিয়ে দিতাম। কিন্তু ভেবে পাই না, এখন আমাদের সেই শৌর্য-বীর্ষ গেল কোথায়? আজ আমরা গ্রাম্য বুদ্ধ আরবদের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। রাখাল ওরা। তাঁবু খাটিয়ে জীবন গুজরায়। অথচ আজ এদের হাতেই মার খাচ্ছে অপরাজিত রুশ বাহিনী। আচ্ছা বল তো, এরা কি? কেন এমনটি ঘটছে? এদের কি সাম্রাজ্যের দাপট আছে?

দরবারী আমলাটি সবিনয়ে বলল ঃ হুজুর, এমন কিছু নয়। সম্রাট বললঃ তাহলে বলঃ কারণটি কি? আমলাটি বলল, তাহলে আমাকে একটু সুযোগ দিতে হবে। সম্রাট বললঃ বল, তুমি যা বলতে চাও, বল!

আমলাটি বললঃ “রাতের বেলায় তারা ইবাদতে বিভোর সূফী-সাধক আর দিবসে তারা অশ্বারোহী যোদ্ধা। নিশি কাটে তাদের বিনয়কাতর ইবাদতে, দিন যায় ঘোড়ার উপর আল্লাহর রাহে। রাতের আঁধারে যদি আপনি মসজিদে প্রবেশ করেন তখন কুরআন তিলাওয়াতের মৃদু গুঞ্জরণ ছাড়া অন্য কোন শব্দ শুনতে পাবেন না। তারা মৌমাছির মত অনুচ্চ-উচ্চারণে অনবরত তিলাওয়াতে রজনী কাটায়। মূল্য আদায় না করে কোন দোকান থেকে সওদা গ্রহণ করে না। তাদের নেতার পুত্র চুরি করলেও তার হাত কেটে দেয় নিঃসংকোচে ।”

একথা শুনে সম্রাট বললেনঃ “তুমি যদি সত্য বলে থাক তাহলে ‘খোদার কসম’, নিশ্চয় তারা জয় লাভ করবে এবং আমার এই পায়ের তলা পর্যন্ত কব্জা করে ফেলবে।” বাস্তবে হয়েছিলও তাই।

আজ সেই সমাজেরই বড় প্রয়োজন। আমাদের সভ্যতা বেশ উন্নতি লাভ করেছে এতদিনে। উন্নতির শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছে। মানুষ এখন হাওয়ায় উড়ে। চাঁদের দেশে ঘুরে বেড়ায়। ডক্টর ইকবালের ভাষায়- “সূর্যের আলোেক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে; মাটির মানুষ হয়ে বিচরণ করতে পারে চাঁদের রাজ্যে অথচ সে-ই পৃথিবীতে মানুষের মত সুন্দর হয়ে চলতে পারে না।”

এক ভারতীয় আলেম এক ইংরেজ দার্শনিককে এ ধরনের একটি সুন্দর কথা বলেছিলেন। এই ইংরেজ গবেষক সভ্যতা-সংস্কৃতি প্রগতি নিয়ে কথা বলছিল ভারতের মাওলানার সাথে। পশ্চিমা সভ্যতা অপ্রতিরোধ্য বিজয় বেগবান শিল্পস্রোত নিয়ে কথা বলছিল । সে গর্বে-দর্পে বলে যাচ্ছিল, আমরা তো বিশাল গিরিসংকট অতিক্রান্ত করেছি। বিশাল বালিয়াড়ি মাড়িয়েছি। এতখানি সময়ের পরিসরে এত এত পথ চলেছি। আমরা এখন আকাশপথে ঘুরে বেড়াই। সময়ের সংক্ষিপ্ত অংশে বিশাল কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলি আমরা। আমরা এই করেছি, সেই করেছি……

ভারতীয় মাওলানা সাহেব বললেনঃ “জী, সব ঠিক। আপনারা আকাশে উড়ে বেড়ান পাখির মত, সমুদ্রে বিচরণ করেন মাছের মত। তবে দুঃখ হলো, আপনারা মাটিতে চলতে পারেন না মানুষের মত ।” পশ্চিমা সভ্যতা মূলত স্ববিরোধী সভ্যতা। এই সভ্যতা শিল্পের চূড়ান্ত শিখর দলিত করেছে। বিজ্ঞানে অসাধারণ বিজয় এনেছে। গবেষণার অগণন দিগন্ত উন্মোচনের গৌরব অর্জন করেছে। কিন্তু মানবতার জগতে পরিচয় দিয়েছে দারিদ্র্যের, প্রচণ্ড দৈন্যের।

আজ আমি যে সভ্যতার কথা বলছি, সে সমাজটি প্রতিষ্ঠিত হবে একটি মুসলিম দেশে। কাঙ্ক্ষিত সে সমাজটি যদি একবার বাস্তবায়িত হয়, আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি, তখন বিশ্বের সকল পর্যটক ছুটে আসবে সেই সমাজটি একবার দেখার জন্যে। আমি বলি পর্যটকরা নয় বরং সকল তৃষ্ণাকাতর চাতকেরা হন্যে হয়ে চুটে আসবে স্বপ্নের সেই শহরটিতে একটি দিন কাটাবার আশায়, অন্তত কিছু সময়ের জন্যে। কারণ, তারা আজ যন্ত্রচালিত জীবন-যাপনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তারা রাজনৈতিক শক্তি, যুদ্ধ ও অর্থের বলে রাজ্য দখল করে; অথচ তারা জীবনের প্রাণ পায় না সেখানে। রোমান্টিকতায় বিরাগিত তারা এখন অধীর আগ্রহে তারা এখন খুঁজে বেড়াচ্ছে নিবিড়-শান্ত একটি সমাজ, যেখানে সততা আছে, চরিত্রের উপমাময়ী চিত্রায়ণ আছে, আছে নিরাপত্তা। তাই তারা যখন শুনবে কোন একটি মুসলিম দেশে সেই সমাজ গড়ে উঠেছে, সূর্যের মুখ দেখেছে সেই প্রার্থনীয় সমাজ ব্যবস্থা, পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে, তাৱা সে দিকেই যাত্রা করবে। সুদীর্ঘ পথ মাড়িয়ে হাযির হবে সেই স্বপ্নপুরীতে।

সেই সমাজ প্রতিষ্ঠার উপায় মাত্র একটি মসজিদের মিম্বর থেকে হবে যার নির্দেশনা। দীনী গবেষণা, ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ হবে যার প্রাণশক্তি। এটা অনস্বীকার্য সত্য, যতদিন পর্যন্ত মুসলমানগণ আলেম-উলামার সাথে সম্পর্ক রাখবে, ধর্মীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত থাকবে, দীনী গবেষণার সূত্র থাকবে গ্রন্থিত। তাহলেই মুসলমানদের জীবনের চলমান অস্থিরতা ও সংঘাতময়তার অবসান ঘটবে।

আজ মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্যের প্রাচীর গড়ে উঠেছে। ঐক্যের বুনিয়াদ রাখতে পারে নামায-রোযা। কিন্তু লেন-দেনের দুর্বলতা, আচার-আচরণের বিপর্যয়, ফরয-ওয়াজিব পালনে অনীহা এসব শোধরাবার উপায় কি? কোথাও ভালো পরিবেশ নজরে পড়লেও ঘরে-বাড়িতে তা নেই। পারিবারিক জীবন ধর্মীয় আদর্শে গড়ে উঠেনি। অথচ ভালো পরিবেশের সুন্দর গুণাবলীর প্রয়োজন সর্বত্র। একই আদর্শের রঙে একীভূত পরিদৃষ্ট হবে সমগ্র মুসলমানদের সামগ্রিক জীবন। এক রঙা মনে হবে সকলকে। বিভেদের ক্ষীণতম দাগও থাকবে না কোথাও। ইসলাম ও মুসলমানের উজ্জ্বলতম চিত্র দেখতে চাইলে বলা হবে, মসজিদে যাও। কারণ সেখানে তো আর মুসলমানের বাইরে কেউ নেই।

আমি এ সুবাদে একটি উপমা দিচ্ছি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আমাদের ভারতের কথা। ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু জাতি। সেখানে আমরা মানবতার পয়গাম’ নামে একটি আন্দোলন শুরু করেছি। এর কর্মসূচীর আওতায় আমরা মুসলমানদের সাথে কথা বলি। অমুসলিমদের প্রতিও তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি আমরা তাদের আহ্বান করি সৎ চরিত্র, পবিত্র জীবন ও আদর্শিক জীবনবোধের প্রতি। সম্পদ ও বস্তুপূজা থেকে ফিরে আসতে বলি তাদেরকে। ঘুষ, খেয়ানত, আত্মসাৎ, রক্তারক্তি, খুন-খারাবি থেকে পবিত্রতা ও স্বচ্ছতার প্রতি আহ্বান করি। আমরা বলি মুসলমান ভাইদেরকে তোমরা তো চাইলে এখনো এদেশকে শাসন করতে পার। কারণ, এদেশ এখন আত্মঘাত ও সর্বগ্রাসী ধ্বংসের দিকে ক্রমধাবমান। ভয়ানক লয় ও বিনাশের দিকে চলছে দেশ। শুধু ভারত কেন! পৃথিবীর সকল সমাজের অবস্থা তো একই অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষ বাস্তবতা থেকে বলছি, সারা পৃথিবী এখন দ্রুত প্রলয়ের দিকে ছুটেছে। চলেছে মহাধ্বংসের দিকে। আমি তাদেরকে বলি, তোমরা যদি ইসলামের আদর্শের বাস্তব অনুসারী হয়ে যাও, ইসলামী জীবনধারায় যদি প্রতিষ্ঠিত হও তোমরা, তাহলে তোমরাই এদেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে। আল্লাহ্ তা’আলাও বলেছেন : “এবং নিশ্চয় আমি লওহে মাহফুজের পর আসমানী কিতাবসমূহে লিখে দিয়েছি, আমার সং বান্দারাই পৃথিবীর মালিক হবে।” আমি তাদেরকে জীবনের দুর্বলতাগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বলেছি আচার-আচরণ, ব্যবহার-চরিত্র, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সকল প্রকার দায়িত্বের ক্ষেত্রে পরিশুদ্ধতা আনয়নের মাধ্যমে নেতৃত্বের প্রতি আগুয়ান হও। আল্লাহ্ বলেছেন“(হে রাসূল!) আপনি তাদের মধ্যে থাকা অবস্থায় আল্লাহ্ তাদেরকে আযাব দিবেন না। তারা যদি ক্ষমা প্রার্থনা করে তাহলেও তাদেরকে আযাব দিবেন না।” এখন নবী নেই। তাঁর উম্মত আছে। এবং তারা থাকবে। তাদের বর্তমানে যদি কোন দেশ ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে তারা নিশ্চয় জিজ্ঞাসিত হবে। জিজ্ঞাসিত হবে আল্লাহর দরবারে, ইতিহাসের কাঠগড়ায়। প্রশ্ন করা হবে, তোমরাই তো ছিলে কাণ্ডারী। নৌকা ডুবে গেল কি করে? তাই বলি তোমরা চরিত্র ও মানবতার বলে জাতির নেতৃত্ব দিতে চেষ্টা কর। মানুষ তোমাদের সম্মান ও শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখবে।

রাজনৈতিক টানাপড়েন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর বস্তুবাদের লড়াই তো তোমাদেরকে সম্মানিত করতে পারবে না। বরং তোমরা যদি আত্মম্ভরিতার ললাটে লাথি মেরে, রিপু ও বস্তুপূজা বর্জন করে মানবতার জন্যে উৎসর্গিত হতে পার তাহলে পৃথিবী আবার তাকাবে তোমাদের প্রতি সম্মানের দৃষ্টিতে, তোমাদেরকে মনে করবে মুক্তিদূত। এভাবেই গড়ে ওঠা দরকার আজ সেই কাঙিক্ষত সমাজ। স্বপ্নের সেই সমাজের অপেক্ষায় আজ অধীর বিশ্ব প্রকৃতি; যার শীতোষ্ণ ছোঁয়ায় একবার আন্দোলিত হয়েছিল পৃথিবী। সেই স্বাদ আজো ভুলেনি। কিন্তু আরেকবার পাবে তো সাক্ষাৎ।


সংকলক : আবু তাসনীম উমাইর

আরো জানতে ভিজিট করুন আমাদের ওয়েব সাইট রাহে সুন্নাত ব্লগ

প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন-দর্শন
আদর্শ সেনানায়ক মহানবী The ideal commander is the Prophet

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *