আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সংজ্ঞা ও পরিচয়
প্রশ্ন : বর্তমানে সারা বিশ্বে কোন দলটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্তভুর্ক্ত?
উত্তর : এই বিষয়ে আলোচনা করার পূর্বে জানতে হবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মৌলিক বৈশিষ্ট্য কী?
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত বলতে দুটি বিষয় বোঝায়।
এক. ইত্তেবায়ে সুন্নাত অর্থাৎ সুন্নাতের অনুসরণ করা।
দুই. ইজমায়ে উম্মাত অর্থাৎ উম্মাতের ঐকমত্য। এই দুটি বৈশিষ্ট্য যাদের মধ্যে পাওয়া যায়, তাদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত বলা হয়।
প্রথম বিষয় ইত্তেবায়ে সুন্নাত : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের সাথে খোলাফায়ে রাশেদীনদের সুন্নাতও অন্তভুর্ক্ত। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যতদিন দুনিয়াতে ছিলেন, ততদিন সাহাবায়ে কেরামগণ প্রতিটি আমল ও প্রতিটি কাজ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে জিজ্ঞেস করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত তরিকায় পালন করতেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পরবর্তী উম্মাতদেরকে তাঁর সুন্নাতের অনুসরণের সাথে সাথে খোলাফায়ে রাশেদীনদের সুন্নাতের অনুসরণ করার জন্য এবং তা মজবুতভাবে অঁাকড়ে ধরার জন্য উৎসাহিত করেছেন। যেমন হাদিস শরীফে এসেছে-
فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِيْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ.
অর্থ : তোমরা আমার এবং খোলাফায়ে রাশেদীনদের সুন্নাত তথা আদর্শকে অঁাকড়ে ধরবে, দৃঢ় হাতে ধারণ করবে এবং দাঁত দিয়ে অঁাকড়ে ধরবে।
এই হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম بهـما দ্বি—বচন সর্বনাম ব্যবহার করেননি বরং بها একবচন সর্বনাম ব্যবহার করেছেন।
আর নিয়ম হলো : জমির (সর্বনাম) তার নিকটতম মারজেয় (প্রত্যাবর্তন স্থল) এর দিকে ফিরে। সুতরাং এখানে هـا জমিরের (সর্বনামের) মারজা হবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কতৃর্ক খোলাফায়ে রাশেদীনদের সুন্নাতের প্রতি গুরুত্বারোপ করা।
কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত প্রত্যেক মুসলমানই নির্দ্বিধায় মেনে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু কেউ কেউ খোলাফায়ে রাশেদীনদের সুন্নাত মানার ক্ষেত্রে সন্দিহান বা অস্বীকারকারী হতে পারে। সেজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের সুন্নাতের সাথে খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত শক্তভাবে ধারণ করার জন্য উম্মাতের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন।
দ্বিতীয় বিষয় ইজমায়ে উম্মাত, যা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
وَ مَنْ یُّشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْۢ بَعْدِ مَا تَبَیَّنَ لَهُ الْهُدٰی وَ یَتَّبِعْ غَیْرَ سَبِیْلِ الْمُؤْمِنِیْنَ نُوَلِّهٖ مَا تَوَلّٰی وَ نُصْلِهٖ جَهَنَّمَ ؕ وَ سَآءَتْ مَصِیْرًا۠۱۱۵
অর্থ : যে কেউ রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তার কাছে সরলপথ প্রকাশিত হওয়ার পর এবং সব মুসলমানের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ঐ দিকেই ফেরাব যে দিক সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থান।
এই আয়াত ইজমায়ে উম্মতের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় দলিল।
সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত দুটি জিনিসের সমষ্টির নাম।
এক. খোলাফায়ে রাশেদীনদের সুন্নাতের অনুসরণসহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ করা।
দুই. ইজমায়ে উম্মাহ : (উম্মাহর সর্বসম্মত মত) সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্তভুর্ক্ত হওয়ার জন্য সুন্নাতের অনুসরণ করা এবং ইজমায়ে উম্মাহকে মান্য করা অপরিহার্য কর্তব্য।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর উম্মাতের মধ্যে বিভক্তি ও মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছিল এবং অনেক মতবাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। অনেকে তো মূল দ্বীনকে অস্বীকার করে কাফির ও মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু অধিক সংখ্যক মুসলমান মূল দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। অতঃপর কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর মুসলমানদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মুসলমান কুরআন—হাদিসের স্পষ্ট বিষয়ে মতানৈক্য করতে শুরু করল। যেমন : কবরের সাওয়াল—জাওয়াব, পুলসিরাত অতিক্রম করা, কিয়ামতের দিন আল্লাহর দিদার (দর্শন) লাভ করা, মিযানের পাল্লায় আমল মাপা, ওলিদের কেরামত সত্য হওয়া ইত্যাদি বিষয়সমূহকে তারা যুক্তির আলোকে বোঝার চেষ্টা শুরু করল। যে কারণে তারা কুরআন—হাদিসের স্পষ্ট বিষয়ে অপব্যাখ্যা ও অস্বীকার করার পথ বেছে নিয়ে ছিলেন। যার কারণে তারা সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে ছিলেন। তাদের মোকাবিলায় অধিক সংখ্যক মুসলমানদের জামাআত কুরআন—হাদিসের অনুসরণ করার ব্যাপারে : مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ
হাদিস অনুযায়ী সাহাবায়ে কেরাম এবং সলফে সালেহীনদের পথকে নিজেদের পথ হিসেবে গ্রহণ করলেন এবং নিজেদের পরিচয় হিসেবে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত’ শিরোনাম গ্রহণ করেন। এই দলটিই বাড়াবাড়ি মুক্ত এবং সিরাতে মুসতাক্বিমের উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) লিখেছেন-
فإن السنّة تتضمّن النصّ والجماعة تتضمّن الإجماع فأهل السنّة والجماعة هم المتّبعون للنّصّ و الإجماع
অর্থ : নিশ্চয় ‘সুন্নাহ’ শব্দটি নস্ (মূল সূত্র)—কে অন্তভুর্ক্ত করে এবং ‘জামাআত’ শব্দটি ইজমায়ে উম্মাহকে অন্তভুর্ক্ত করে।
অতএব, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারীগণ নস এবং ইজমায়ে উম্মাহ তথা উম্মাহর ঐকমত্যের অনুসরণ করে থাকেন।
সুতরাং যারা দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে মানার পাশাপাশি ইজমায়ে উম্মাহ এবং খোলাফায়ে রাশেদীনদের সুন্নাতসহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করবেন, তারাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্তভুর্ক্ত হবেন।
فقط والله تعالى أعلم
(আল্লাহ তায়ালা সবচেয়ে ভালো জানেন)।
সমাধানে :
আল্লামা মুফতী জয়নুল ইসলাম কাসেমী ইলাহাবাদী
মুফতী, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত।
০১/ ১১/ ১৪৩১ হিজরী
উল্লিখিত ফাতোয়ার ব্যাপারে দারুল উলুম দেওবন্দের শাইখুল হাদিস, আল্লামা মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী (দা. বা.)—এর অভিমত
আলহামদুলিল্লাহ! সমাধান সম্পূর্ণ সঠিক হয়েছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে শুধু হানাফী, শাফেয়ী, মালিকী, হাম্বলী মাজহাবের অনুসারীদের মধ্যেই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত হওয়া সীমাবদ্ধ।
আল্লামা আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ তাহতাবী রহ. (মৃত্যু ১২৩১ হিজরি) যিনি হানাফী মাযহাবের একজন প্রসিদ্ধ ফক্বিহ ও আল্লামা শামী (রহ.)—এর উস্তাদ ছিলেন। তিনি আদ্দুররুল মুখতারের টিকায় ‘কিতাবুয্ যাবায়েহ’—এর মধ্যে লিখেছেন-
فعليكم معاشر المؤمنين بإتباع الفرقة الناجية المسمّاة بأهل السنّة و الجماعة …… وهذه الطائفة الناجية قد إجتمعت اليوم في مذاهب أربعة. و هم الحنفيون و المالكيون والشافعيون و الحنبليون رحمهم الله. و من كان خارجا من هذه الأربعة في هذا الزمان فهو من أهل البدعة و النار.
অর্থ : হে মুমিনগণ! আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত নামক নাজাতপ্রাপ্ত দলের অনুসরণ করা তোমাদের উপর আবশ্যক করে নাও। এই নাজাতপ্রাপ্ত দলের বৈশিষ্ট্য বর্তমানে শুধু চার মাযহাবের অনুসারীদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। আল্লাহ্ তায়ালা তাহাদের উপর রহমত বর্ষণ করুন! বর্তমানে যারা চার মাযহাবের অনুসরণ করে না, তারা পথভ্রষ্ট ও জাহান্নামিদের অন্তভুর্ক্ত।
হাকীমুল উম্মাত আল্লামা আশরাফ আলী থানবী (রহ.) তার লিখিত ‘মিয়াতু দুরুস’ নামক কিতাবের ৯৫ নং সবকে লিখেছেন-
الدرس الخامس و التّسعون في المذاهب المنتحلة إلى الإسلام في زماننا: أهل الحق منهم:أهل السنّة و الجماعة المنحصرون بإجماع من يعتدّ بهم في الحنفيّة والشافعيّة و المالكيّة والحنابلة
অর্থ : বর্তমান যুগে যেসব মতালম্বীকে ইসলামের দিকে সম্বোধন করা হয়, তাদের মধ্যে আহলে হক্ব হলো: আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত যা উম্মাতের ঐকমত্যে শুধু হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী তথা উল্লিখিত চার মাযহাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
লিখেছেন
সাঈদ আহমদ পালনপুরী
শাইখুল হাদিস, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত।
পদমর্যাদার মাপকাঠি হলো পবিত্র কুরআন
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর প্রেরীত চিঠির ব্যাখ্যা PDF ডাউনলোড করতে ক্লিক করুন
মহানবী জগতের আদর্শ মহামানব। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
মানব জাতির মুক্তি ও কামিয়াবী সুরাতুল আসরের ৪ মূলনীতির আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক
১. মিশকাতুল মাসাবিহ ৩০ পৃ., কিতাবুল ঈমান, বাবুল—ইতেসাম বিল কিতাব ওয়াস্ সুুুুুুুুুুুুুুুুন্নাহ।
. সুরা—নিসা আয়াত নং ১১৫
১.
روي أن الشافعي : سئل عن آية في كتاب الله تعالى تدلّ على أن الإجماع حجّة. فقرأ القرآن ثلاث مأة مرة حتى وجد هذه الآية و تقرير الإستدلال: أن إتباع غير سبيل المؤمنين حرام فوجب أن يكون إتباع سبيل المؤمنين واجبا.
কথিত আছে যে, ইমাম শাফি (রহ.) কে কুরআনের ঐ আয়াতের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছে, যে আয়াত দ্বারা ‘ইজমায়ে উম্মাহ’ দলিল হওয়ার বিষয়টি বোঝা যায়। অতঃপর তিনি কুরআন শরীফ তিনশো বার তিলাওয়াত করে এই আয়াতটি ইজমার স্বপক্ষে পেয়েছেন। দলিলের মোদ্দাকথা হলো, নিশ্চয় মুমিনদের পথ পরিহার করে অন্য পথ অবলম্বন করা হারাম । সতুরাং মুমিনদের পথ অনুসরণ করা ওয়াজিব। (মাফাতিহুল গায়িব (তাফসিরে রাজী) ১১তম খণ্ড ৩৫ পৃ., সূরা নিসা দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বাইরুত।
و إستدل الإمام الشافعي على حجيّة الإجماع بهذه الآية.
ইমাম শাফি (রহ.) এই আয়াত দ্বারা ইজমায়ে উম্মাহ দলিল হওয়ার উপর প্রমাণ পেশ করেছেন। (রুহুল মাআনী)
و الآية تدلّ على حرمة مخالفة الإجماع.
এই আয়াতটি ইজমায়ে উম্মাতের বিরোধিতা করা হারাম হওয়ার প্রমাণ বহন করে। (তাফসিরে বায়যাবী ১ম খণ্ড ২৩৭ পৃ. সুরা নিসা ১১৫ নং আয়াত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বাইরুত।
.
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ : لَمَّا تُوُفِّيَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاسْتَخْلَفَ أَبُوْ بَكْرٍ بَعْدَه وَكَفَرَ مَنْ كَفَرَ مِنَ الْعَرَبِ
অর্থ : হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর যখন হযরত আবু বকর (রাযি.)—কে খলিফা বানানো হলো, তখন আরবের কিছু মানুষ কুফরী করতে শুরু করে। সহিহ বুখারী হাদিস নং ৭২৮৪ বাবুল ইকতিদা বি সুনানি রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
. মিনহাজুস্ সুন্নাহ ৩য় খণ্ড ২৭২ পৃ. মিশর।
. হাশিয়াতুত্ তাহ্তাবী আলাদ্দুরি্রল মুখতার ৪র্থ খণ্ড ১৫৩ পৃ.।
. মিয়াতু দুরুস, সবক নাম্বার ৯৫।