ইমাম বুখারী রহ. ও তাঁর আম্মার দুআ
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, পিতা-মাতা যখন সন্তানের জন্য দুআ করেন, তখন সে দুআ প্রত্যাখ্যাত হয় না। (অর্থাৎ তা অবশ্যই কবুল হয় ।)
যুগে যুগে মহান এই ঐশী বাণীর বহু প্রমাণ ও সত্যতার স্বাক্ষী রয়েছে । তার অন্যতম একটি উজ্জ্বল দৃষ্টাত্ত হলো ইমাম বুখারী । বিরল প্রতিভা ও অনন্য মেধার অধিকারী ক্ষণজন্মা এই মহামনীষীর জীবনের এই অংশটি এখানে সংক্ষেপে পেশ করছি।
১৯৪ হিজরী সনের ১৩ শাওয়াল, শুক্রবার জুমার নামাযের পর ‘বুখারা’ শহর এমন এক শিশু জন্ম নিতে দেখেছে, যার জন্মে পিতা খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন এবং তার নাম রেখেছিলেন ‘মুহাম্মদ’। ইতিপূর্বে পিতা তার আরেক ভাইয়ের নাম রেখেছিলেন ‘আহমদ’ । বাবার উদ্দেশ্য ছিল এর মাধ্যমের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র নামের বরকত লাভ করা।
ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম ইবনে মুগীরা। একজন মুহাদ্দিস। আবদুল্লাহ ইবনে মুবারকের সাথে মিলিত হয়েছেন। তার সাথে মুসাফাহা করেছেন। হাম্মাদ ইবনে যায়দসহ অন্যান্য মুহাদ্দিস থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইরাকের মুহাদ্দিসীন ও উলামায়ে কেরাম তার থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর চেয়েও তাঁর বড় পরিচয় হলো তিনি ইমাম বুখারী রহ. এর আব্বাজান। তিনি সত্যিকারের একজন পূণ্যবান ও খোদাভীরু ব্যক্তি ছিলেন। শিশু মুহাম্মদের জন্মের পর তিনি হজ্বের উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা নগরীতে আগমণ করেন। যথারীতি হজ্ব সম্পাদনের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র রওযা মুবারক যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনা মুনাওয়ারাতে গমন করেন। এখানে তিনি ‘ইমামু দারিল হিজরাহ’ খ্যাত ইমাম মালেক রহ. এর সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হন এবং তাঁর কাছ থেকে বেশকিছু হাদীসও শ্রবণ করেন। এরপর কিছুদিন যেতে না যেতে শিশু মুহাম্মদ বেড়ে ওঠার আগেই পিতা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে চলে যান। মৃত্যুর পূর্বে তিনি এমন কিছু কথা বলেন যা তাঁর একনিষ্ঠ ধার্মিকতা ও প্রকৃত খোদাভীরুতার প্রমাণ বহন করে।

ইমাম বুখারী রহ এর পিতার বক্তব্য
পিতা ইসমাইল বলেন, ‘আমার সম্পদে অবৈধ উপায়ে উপার্জিত একটি দিরহাম থাকা তো দূরের কথা; সন্দেহযুক্ত একটি দিরহামও নেই। অবশেষে তিনি মহান প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান। মৃত্যুকালে তাঁর অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস ছিল যে, সম্পূর্ণ বৈধ সম্পদে বেড়ে ওঠা তার পরিবারকে মহান আল্লাহ কখনো ধ্বংস করবেন না।
পিতা ইসমাঈলের মৃত্যুর পর তাঁর বিধবা স্ত্রী সন্তানদ্বয়ের লালন-পালনে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন এবং অত্যন্ত সূচারুরূপেই তিনি তাদের লালন-পালনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কুদরতের দূর্ভেদ্য রহস্যময় লীলা, স্বামীর মৃত্যুশোক কেটে উঠতে না উঠতে এমন একটি ঘটনা ঘটে গেল যা তাঁর স্বাভাবিক জীবন চলার পথকে রুদ্ধ করে দিল। রাতের ঘুমকে করেছে হারাম, চিত্তস্থৈর্য হয়েছে উধাও আর মনের উৎকণ্ঠাকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে।
কলিজার টুকরো শিশু মুহাম্মদের দৃষ্টিশক্তি হঠাৎ লোপ পেয়ে গেল, সে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছেনা। যেখানে একজন মা সন্তানের সামান্যতম অসুস্থতায় বিচলিত হয়ে পড়েন, সেখানে সন্তান যদি আকষ্মিকভাবে তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে, তাহলে মমতাময়ী কত অস্থির ও বিচলিত হবেন মা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কেউই তা উপলব্ধি করতে পারবে না। কারণ, দৃষ্টিশক্তিই মানবজীবনের অন্যতম চালিকাশক্তি এবং চলার পথের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যার শূন্যতা শুধু মানুষের স্বাভাবিক জীবনকেই রুদ্ধ করেনা, বরং পুরো পৃথিবীই তাঁর কাছে অন্ধকার । স্বাধীন সত্তার মানুষ হয়েও সে পুরোপুরি পরনির্ভশীল । যা তাঁকে স্বাভাবিক নিয়মে জ্ঞানার্জন থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, দুনিয়ার সৌন্দর্য, জীবনের স্বাদ, ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করা ও স্বাধীনভাবে চলাফেরার পথে এক বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি করে ।
কী করবেন এ অসহায় বিধবা? তাঁর আদরের ছোট ছেলেটি এক জায়গায় বসে আছে। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছে না। চলতে গেলে হোঁচট খাচ্ছে। প্রতিটি কাজেই সে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে গেল। এমতাবস্থায় মহান আল্লাহই তাকে সাহায্য করলেন । যার রহমতের দরজা কখনো রুদ্ধ হয় না, বান্দা ও যার মাঝে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়না, যার নেয়ামতরাজি অফুরন্ত, যার অনুগ্রহ অশেষ । তিনি এই অসহায় মায়ের অন্তরে এই কথার ভাবোদয় ঘটালেন যে, তুমি মহান আল্লাহর কাছেই আশ্রয় গ্রহণ কর এবং তার অশেষ বদান্যতা ও অসীম করুণা ভিক্ষা কর।
শিশু মুহাম্মদের মা মহান আল্লাহর পক্ষ হতে তার অন্তরে সৃষ্ট এই ঐশী আহবানে সাড়া দিলেন। যখন রাতের অন্ধকার নেমে আসত, শিশু মুহাম্মদ ও তার ভাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যেত এবং পুরো বুখারা শহরে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করত, তখন তিনি উঠে অযু করে নামাযে দাড়িয়ে যেতেন এবং মহান আল্লাহর দরবারে তাঁর দৃষ্টি হারানো শিশু মুহাম্মদের জন্য খুব অনুনয়-বিনয় করে কান্নাকাটি করতেন, তাঁর অন্তরের ব্যথা ও পরিবারের দুঃখের কথা মহান আল্লাহর দরবারে পেশ করতেন। এভাবে বেশ কিছুদিন চলে গেল । মহান আল্লাহর দরবারে তাঁর গভীর রাতের এই করুনা ভিক্ষা, দুঃখের অভিযোগ পেশ এবং আল্লাহর রহমতের দরজায় করাঘাতের মুহূর্তগুলো আল্লাহ তাআলার কাছে খুব পছন্দ হল। মহান আল্লাহর করুণার দরজায় কেউ করাঘাত করলে সে নিরাশ হয় না ।
এক গভীর রাতে শিশু মুহাম্মদের মা ঘুম থেকে ওঠে যথারীতি নামায আদায় করলেন। অতঃপর আল্লাহর দরবারে খুব বেশি কান্নাকাটি করলেন। হঠাৎ তিনি নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন। স্বপ্নে দেখলেন, ইবরাহীম আ. তাকে বলছেন, হে মহিলা। তোমার অধিক কান্নাকাটির কারণে মহান আল্লাহ তোমার ছেলের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। এই স্বপ্ন দেখার সাথে সাথে তিনি জেগে উঠলেন। স্পষ্ট সুসংবাদবাহী এই স্বপ্ন দেখে তাঁর অন্তর দুরু দুরু কাঁপছে। তিনি অধীর আগ্রহে সকালের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।
ফজরের আযান হলো। মুহাম্মদের মা তাঁর সস্তানদ্বয়কে নামাযের জন্য জাগিয়ে দিলেন। তখনই দেখতে পেলেন তাঁর স্বপ্নের সত্যতা। শিশু মুহাম্মদ যথারীতি সবকিছু দেখছে। নিজে নিজে অযু করছে। তিনি শুকরিয়া জ্ঞাপন করতে মহান আল্লাহর দরবারে সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন এবং আনন্দের অশ্রুধারায় বুক ভাসালেন। আল্লাহ তাআলার আরো অধিকতর শুকরিয়া জ্ঞাপন করার মানসে তিনি পবিত্র কাবা ঘর যিয়ারতের ইচ্ছা পোষন করলেন।
এই উদ্দেশ্যে তিনি সস্তান দু’টিকে সাথে নিয়ে মক্কা নগরীতে গমন করেন। ২১০ হিজরী সনে সবাই একসাথে হজ্ব সম্পাদন করেন। অতঃপর মুহাম্মদের মা ও তাঁর ভাই আহমদকে নিয়ে বুখারায় ফিরে আসেন। তবে মুহাম্মদ ফিরে না গিয়ে সেখানে জ্ঞানার্জনে আত্মনিয়োগ করেন। এরপর তিনি তাঁর জ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করার নিমিত্তে ইরাক, শাম ও মিশরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে ভ্রমণ করেন এবং প্রায় ১৮০০ শিক্ষকের নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করেন। ধীরে ধীরে তার অসাধারণ মেধা ও অনন্য প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে এবং তাঁর সমবয়সীদের ওপর তিনি বিশেষ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে উঠলেন। তাঁর সুনাম-সুখ্যাতি দিক দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ল।
তিনি জ্ঞান, কর্ম ও কৃতিত্বের এমন উচ্চস্তরে উপণীত হয়েছেন যে, তার উপস্থিতি পুরো জাতির জন্য মহাগৌরব ও শোভাবর্ধন করত। তার জীবনের শুভ দিনগুলো কল্যাণের মৌসুমে পরিণত হয়েছিল। দেশে দেশে তাঁর আগমনে আনন্দ বয়ে যেত এবং উলামায়ে কেরাম তাঁর দর্শন লাভের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। তাঁর এমন আশেক-ভক্ত রয়েছে যারা নিজেদের জীবনের একটি অংশ তাঁর জন্য দিয়ে দিতেও প্রস্তুত ছিলেন।
প্রখ্যাত আলেম ইয়াহইয়া ইবনে জাফর আলবাইকিন্দী বলেন যদি আমার বয়সের কিছু অংশ মুহাম্মদ ইসমাঈলকে দিয়ে দেয়া সম্ভব হতো, তাহলে আমি তা-ই করতাম । কারণ আমার মৃত্যু হলো একজন সাধারণ মানুষের মৃত্যু, কিন্তু মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈলের মৃত্যু হলো ইলমের মৃত্যু।
২৫৬ হিজরীর ঈদুল ফিতরের রাত্রিতে তিনি ইহকাল ত্যাগ করে আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্যে চলে যান। মহান আল্লাহ ইমাম বুখারী রহ. এর ওপর রহমত বর্ষন করুন। তাকে জান্নাতুল ফিরদাউসের সুউচ্চ মাকাম দান করুন। রহমত বর্ষন করুন তাঁর পিতার ওপর যিনি তাঁর সস্তানকে হালাল ব্যতীত হারাম কিছু খাওয়াননি। অসংখ্য রহমত বর্ষন করুন তাঁর আম্মার ওপর যিনি তাঁকে অত্যন্ত সুচারুরূপে লালন-পালন করেছেন এবং তাঁর হারানো দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে নিরস্তর কেঁদে কেঁদে দুআ করেছেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁর দুআ কবুল করে তাঁর পরিবারকে অনন্য মর্যাদা ও উচ্চতায় আসীন করেছেন।
এই দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার পরেই তো ইমাম বুখারী পুরো পৃথিবীকে ভরে দিয়েছেন প্রজ্ঞার আলোয় ও জ্ঞানের সুষমায়।
আরো জানতে ভিজিট করুন আমাদের ওয়েব সাইট রাহে সুন্নাত ব্লগ