নারী

ইসলামে নারীর মর্যাদা। আবু তাসনীম উমাইর। রাহে সুন্নাত।

ইসলামে নারীর মর্যাদা। ইসলাম ও নারী। রাহে সুন্নাত

ইসলামে নারীর মর্যাদা

প্রথম কথা এই যে, মৌলিক মানবিক অধিকারের ক্ষেত্রে এবং দ্বীন ও ধর্মের যাবতীয় কর্মের ক্ষেত্রে ইসলাম নারীকে পুরুষের সমমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।
বিকৃত ইহুদিধর্ম ও খৃস্টধর্ম যেখানে হযরত আদম আালাইহিস সালামের বিচ্যুতির জন্য হাওয়া আালাইহাস সালামকে অপরাধী সাব্যস্ত করেছে ইসলাম সেখানে আদম ও হাওয়া দুজনকে ভুল ও ক্ষমা প্রার্থনা উভয়ক্ষেত্রে অভিন্ন সাব্যস্ত করেছে। ইরাশাদ হয়েছে-

فأزلهما الشيطن عنها

শয়তান উভয়কে তা থেকে বিচ্যুত করেছে। (সূরা বাকারা : ৩৬)

ভুল শোধরানো সম্পর্কে কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে-

قالا ربنا ظلمنا أنفسنا

তারা উভয়ে বললো, হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা নিজেদের উপর জুলুম করেছি। (সূরা আরাফ : ২৩)

তবে যেহেতু পরিচালক হিসাবে আদমের দায়িত্ব ছিলো বেশী সেহেতু এককভাবে তার সম্পর্কে বলা হয়েছে-

فنسى ولم نجد له عزما

সে ভুলে গিয়েছিল। আমি তাকে সংকল্পে দৃঢ় পাইনি। (সূরা ত্বহা : ১১৫)
নারী ও পুরুষের মৌলিকভাবে সমান অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়ে কোরআনে বলা হয়েছে-

هن لباس لكم و أنتم لباس لهن

এবং নারীদের তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে, যেমন আছে তাদের উপর পুরুষদের। তবে তাদের উপর পুরুষদের এক পর্যায়ের প্রাধান্য রয়েছে। আল্লাহ পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়। (সূরা বাকারা : ২২৮)

এই এক পর্যায়ের প্রাধান্য হল, অভিভাবক ও তত্ত্বাবধানের মর্যাদা, যা সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। আর এটি স্বামী-স্ত্রীর জীবন চলার পথে একটি অপরিহার্য বিষয়।

হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

إنما النساء شقائق الرجال

অর্থাৎ নারীরা হলো পুরুষের সমতুল্য। (সুনানে আবু দাউদ ১/৩১)

আরো ইরশাদ হয়েছে-

من كانت له أنثى فلم يئدها و لم يهنها و لم يؤثر ولده الذكور عليها أدخلها الله الجنة

যে ব্যক্তি কন্যসন্তানকে জ্যান্ত দাফন করবে না এবং তার অমর্যাদা করবে না এবং পুত্রসন্তানকে তার উপর অগ্রাধিকার দেবে না আল্লাহ তাকে জান্নাতে দাখেল করবেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫১০৩)

দ্বীন ও ধর্মের যাবতীয় কর্মে নারী ও পুরুষের সমমর্যাদা সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-

و من عمل صلحا من ذكر أو أنثى و هو مؤمن فأؤلئك يدخلون الجنة يرزقون فيها بغير حساب

আর যে কোন পুরুষ বা নারী নেক আমল করবে, আর সে মুমিন হবে, তাহলে তারা জান্নাতে দাখেল হবে এবং সেখানে তাদেরকে বেলা হিসাব রিযিক দান করা হবে। (সূরা মুমিন : ৪০)

ইসলামে নারীর মর্যাদ প্রবন্ধটি নিজে পড়ুন অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিন শেয়ার করে।

ইসলামে-নারীর-মর্যাদা

আরো ইরশাদ হয়েছে-

فاستجاب لهم ربهم أني لا أضيع عمل عمل منكم من ذكر أو أنثى, بعضكم من بعض

অনন্তর তাদের প্রতিপালক তাদের দু‘আ কবুল করলেন (আর বললেন) যে, আমি তোমাদের কোন আমলকারীর আমল নষ্ট করবো না, সে পুরুষ হোক, বা নারী। তোমরা তো পরস্পরের অংশবিশেষ। (সূরা আলইমরান : ১৯৫)

নারীর সঙ্গে পুরুষের যতগুলো সম্পর্ক হতে পারে প্রতিটি সম্পর্ককে ইসলাম অনন্য মর্যাদা ও মহিমায় অধিষ্ঠিত করেছে। এক্ষেত্রে নারীকে শুধু সমমর্যাদা নয়, বরং অগ্রমর্যাদা দান করেছে।

প্রথম সম্পর্ক হলো মা হিসাবে। তো ইসলাম ও তার নবীর কাছে মায়ের যে মর্যাদা তা পৃথিবীর কোন ধর্ম ও সভ্যতা এমনকি আধুনিক সভ্যতাও কল্পনা করতে পারেনি। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-

ووصينا الانسان بوالديه احسانا حملته امه كرها ووضعته كرها

‘আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচারের আদেশ করেছি। (কারণ) তার মা তাকে কষ্টের সঙ্গে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্টের সঙ্গে প্রসব করেছে।’ (সূরা আহকাফ : ১৫)

এখানে পিতা-মাতা উভয়ের সঙ্গে সদাচার কেন করতে হবে তার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে পিতার কোন অবদানের কথা বলা হয়নি, শুধু মায়ের ত্যাগ ও কষ্টের কথা বলা হয়েছে। অথচ পিতারও বিরাট অবদান রয়েছে সন্তানের জীবনে। এটা এদিকেই ইঙ্গিত করে যে, মাতার ত্যাগ ও কষ্টের তুলনায় পিতার ত্যাগ ও কষ্ট খুবই সামান্য।

হাদীস শরীফে এসেছে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার সদাচারের বেশী হকদার কে? তিনি বললেন, তোমার মা। ছাহাবী বললেন, এর পর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। ছাহাবী বললেন, এর পর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। ছাহাবী বললেন, এর পর কে? তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এর পর তোমার বাবা। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৯৭১)

আফসোস, যে ধর্মের নবী তাঁর উম্মতকে মাতৃজাতি সম্পর্কে এমন উপদেশ দান করেছেন সে ধর্মকে আজ নারী অধিকারের বিরোধীরূপে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। পক্ষান্তরে যেসকল ধর্ম ও সভ্যতার হাতে এবং যে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার হাতে নারীজাতি বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত হয়েছে তারা পেয়ে যাচ্ছে বেকসুর খালাস, বরং উলটো সেজে বসেছে নারীদরদী!

ফিরে আসি হাদীসের আলোচনায়। শুধু এই হাদীসই নয়, বরং অন্য এক হাদীসে বর্ণিত আছে, এক ছাহাবী আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি জিহাদে গমন করতে চাই। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি মা আছেন? ছাহাবী বললেন, আছেন। তখন তিনি বললেন, যাও তার কাছে বসে থাকো, কেননা জান্নাত তার পায়েরই কাছে। (মুসনাদে আহমদ ৩/৪২৯; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ১৩/৮০)

অন্য বর্ণনায় আছে, ‘জান্নাত হলো মায়েদের কদমের নীচে।’ (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ৭৩৩০)

দ্বিতীয় সম্পর্ক হলো স্ত্রী হিসাবে। তো এ সম্পর্কে দেখুন, কোরআন শরীফে আল্লাহ তা‘আলার আদেশ-

و عاشروهن بالمعروف, فإن كرهتموهن فعسى أن تكرهوا شيأ و يجعل الله فيه خيرا كثيرا

আর তোমরা স্ত্রীলোকদের সঙ্গে বসবাস করো সদাচারের সাথে। আর যদি (কোন কারণে) তোমরা তাদেরকে অপছন্দ করো তাহলে হতে পারে যে, তোমরা এমন কোন কিছুকে অপছন্দ করলে, আর আল্লাহ তাতে প্রচুর কল্যাণ রেখে দিলেন। (সূরা নিসা : ১৯)

এ বিষয়টি হাদীস শরীফে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে বলেছেন, ‘কোন মুমিন পুরুষ কোন মুমিন নারীকে যেন সম্পূর্ণ অপছন্দ না করে। কারণ তার একটি স্বভাব অপছন্দ হলে, আরেকটি স্বভাব অবশ্যই পছন্দনীয় হবে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৪৬৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১৯৭৯)

এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী-পুরুষের দাম্পত্যজীবনের এমন একটি মূলনীতি বর্ণনা করেছেন যার উপর আমল করলে এখনই আমাদের সংসার ‘জান্নাত-নযীর’ হয়ে যেতে পারে।

দু’জন নারী-পুরুষ যখন একত্রে ঘর-সংসার করবে তখন একজনের সবকিছু অপরজনের ভালো লাগবে এটা হতেই পারে না। কিছু আচরণ ভালো লাগবে, কিছু মন্দ লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে পুরুষের করণীয় হলো, স্ত্রীর ভালো গুণগুলোর দিকে লক্ষ্য করে আল্লাহর শোকর আদায় করা যে, আলহামদু লিল্লাহ আমার স্ত্রীর মধ্যে এই এই ভালো গুণ তো আছে!
আল্লাহর শোকর আদায় করবে, আবার আন্তরিকভাবে স্ত্রীর প্রশংসা করবে। তখন হয়ত আল্লাহ তার মন্দ স্বভাবগুলো দূর করে দেবেন।

সুতরাং পুরুষের কর্তব্য হলো স্ত্রীর ত্রুটিগুলোর প্রতি ক্ষমাসুন্দর হওয়া, আর ভালো গুণগুলোর কদর করা। কারণ পূর্ণতা তো কোন মানুষেরই নেই। না নারীর, না পুরুষের।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

و عاشروهن بالمعروف, فإن كرهتموهن فعسى أن تكرهوا شيأ و يجعل الله فيه خيرا كثيرا

তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে-ই যে তার স্ত্রীদের জন্য তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম, আর আমি তোমাদের মধ্যে আমার স্ত্রীদের জন্য সর্বোত্তম। (সুনানে ইবনে মাজাহ, পৃ. ১৪২; জামে তিরমিযী, হাদীস : ১১৬২)

উম্মাহাতুল মুমিনীনের প্রতি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ কেমন ছিলো তার বিশদ বিবরণ সীরাতের কিতাবে রয়েছে। মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেক স্বামীর কর্তব্য তা পড়া এবং নিজেদের জীবনে তা আমলে আনা, যাতে প্রতিটি সংসার হতে পারে শান্তির জান্নাত। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা জীবনে কোন নারীকে প্রহার করেননি, বরং যখনই ঘরে প্রবেশ করতেন (তাঁর মনের অবস্থা যেমনই হোক) পবিত্র মুখমন্ডল হাসিতে উদ্ভাসিত থাকতো। তিনি নিজের কাজ নিজে করা পছন্দ করতেন, এমনকি ছেঁড়া জুতা নিজের হাতে সেলাই করতেন। (শামাইলে তিরমিযী; আলমাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ; সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ)

বর্ণিত আছে, তিনি যখন রাতে তাহাজ্জুদের জন্য উঠতেন, ঘরের দরজা খুব আস্তে খুলতেন যাতে ঘরের লোকদের ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটে। আরো বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মুছল্লায় দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদের নামায পড়তেন তখন ঘুমের অবস্থায় মা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার পা মুছল্লার উপর চলে আসতো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদায় যাওয়ার সময় কোমলভাবে মা আয়েশা (রা.)-এর পা সরিয়ে তবে সিজদায় যেতেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৮২; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৫১২)

এজন্য কখনো বিরক্তি বা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন না। সুবহানাল্লাহ!

একটি হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

استوصوا بالنساء خيرا

আমি তোমাদেরকে স্ত্রীলোকদের সম্পর্কে উত্তম আচরণের উপদেশ দিচ্ছি; তোমরা আমার উপদেশ গ্রহণ করো। (জামে তিরমিযী, হাদীস : ১১৬৩)

কন্যা ও ভগ্নি হিসাবে নারীর অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস শুনুন, যার খোলাছা হলো, কারো ঘরে যদি তিনজন বা দুজন কন্যা বা ভগ্নি থাকে, আর সে তাদের উত্তম শিক্ষাদীক্ষা দান করে, তারপর তাদেরকে উত্তম পাত্রে বিবাহ দেয় তাহলে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়। (বুখারী ও মুসলিম) কোন কোন বর্ণনায় আছে, তার উপর জাহান্নাম হারাম হয়ে যাবে। কোন বর্ণনায় আছে, তাহলে সে আর আমি জান্নাতে এরূপ পাশাপাশি থাকবো। তারপর তিনি দুই আঙ্গুল পাশাপাশি রেখে ইশারা করলেন।

এক হাদীসে আছে-

لا تكرهوا البنات, فإنهن المؤنسات الغاليات

তোমরা মেয়েদের অপছন্দ করো না। কারণ তারা অন্তরঙ্গতা পোষণকারী মূল্যবান সম্পদ। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৭৩০৬)

যে কোন পরিবারে আপনি পিতা-মাতার প্রতি কন্যাসন্তানের অনুভব-অনুভূতি এবং সেই তুলনায় পুত্রসন্তানের অনুভব-অনুভূতি পর্যবেক্ষণ করে দেখুন, অবশ্যই আপনার বুঝে আসবে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন কন্যসন্তানদের সম্পর্কে একথা বলেছেন!

  • মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বক্তৃতার নির্দেশিকা প্রবন্ধটি পড়তে ক্লিক করুন।
  • সুন্দর সুন্দর ইসলামিক ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button