ওয়ায়েজগণ শ্রোতাদের প্রতি লক্ষ্য রেখে বিষয়বস্তু নির্বাচন করা

রাহে সুন্নাত ব্লগ সম্পর্কে

ওয়ায়েজগণ শ্রোতাদের প্রতি লক্ষ্য রেখে বিষয়বস্তু নির্বাচন করা

যাদের ঈমান—আকীদা, উযূ, নামায, খাওয়া—দাওয়ার জরুরী মাসআলা—মাসায়েল ও সুন্নাত জানা নেই; তাদের সামনে শুধু মা‘রিফাত আর সূক্ষ্ম দর্শনের কথা বলে কী লাভ? তাদেরকে আগে দ্বীনের জরুরী বিষয় শেখাতে হবে তারপর অন্য কিছু। হযরতওয়ালা মুহিউস সুন্নাহ হারদূঈ রহ. অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বলতেন, তোমরা মসজিদ এবং মাদরাসাকে সুন্নী বানাও। অর্থাৎ, এই দুই স্থানে সুন্নাত জারী কর। তাহলে পুরো এলাকায় সুন্নাত জারী হবে ইনশাআল্লাহ। বর্তমানে দ্বীনের এই দুই মারকাযে সুন্নাতের আলোচনা ও চর্চা কম থাকার কারণে মুসলিম জনসাধারণ থেকেও অনেক সুন্নাত ছুটে গেছে। যদি সমাজের মানুষকে সহীহভাবে সুন্নাতের তা‘লীম দেয়া হয় এবং তার উপর পাবন্দীর সঙ্গে আমল করা হয়, তাহলে সমাজে প্রচলিত বিদ‘আতী কর্মকাণ্ড, মুনকারাত আপনা—আপনি খতম হয়ে যাবে। বৃষ্টির পানিতে যেমন নালা পরিষ্কার হয়ে যায়, তেমনি সুন্নাতের উপর আমলের দ্বারা সমাজ থেকে সমস্ত গুনাহের কাজ বিদূরিত হয়ে যায়।

হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা শাহ আশরাফ আলী থানভী রহ. বলেন, দ্বীনী বিবর্তন বর্তমানে যদি এভাবে পরিমাপ করা যায় যে, শরীয়তের বিধি—নিষেধের উপর একটি পূর্ণাঙ্গ কিতাব হাতে নিয়ে মুসলমানদের দ্বীনী পরিবর্তনের একটি চিত্র একেকজন উম্মতের মাঝে দেখতে থাকুন, মিলাতে থাকুন, বিস্ময় ও তাজ্জব হবেনÑ মুসলমানদের যিন্দেগির সঙ্গে দ্বীনের আহকাম ও বিধি—নিষেধের কতটুকু সম্পর্ক বিরাজমান। দ্বীনের শাখাসমূহে যেমনÑআকাইদ বিশ্বাসে কি পরিমাণ ত্রুটি! নামায, রোযা কি পরিমাণ বর্জন করে নিজকে মুসলমান ভাবছে, উম্মতের কত সংখ্যক এখন নামায রোযার কোনো ফিকিরই করে না, বিবাহ—তালাকের বিষয়টি দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরও ইসলামের বিধান এ দ্বীনী বিষয়টিতে চরমভাবে উপেক্ষিত। বিজাতীয় তরীকা গ্রহণ করার এ যেন সীমাহীন প্রতিযোগিতা।

যা হোক প্রথম শাখা আকাইদে মূল অবস্থান থেকে বহু পরিবর্তন ঘটেছে। দ্বিতীয়ত মূল বিষয় নামায, রোযাকে অধিকাংশই বর্জন ও উপেক্ষা করে চলছে। মু‘আমালাত, মু‘আশারাত ও আখলাক দ্বীনের তিনটি শাখায় সাধারণ মুসলমানতো অজ্ঞতার কারণে এগুলোকে দ্বীনের শাখাই মনে করছে না। এ তিন শাখায় বিবর্তন ও বিবর্জন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বরং সেগুলোকে নিছক পার্থিব (দুনিয়াবী) ব্যাপার মনে করে নিজেদের খেয়ালখুশী মতো তা করে যাচ্ছে। এ সকলক্ষেত্রে শরীয়তের বিধানের বিকল্প নিজস্ব বিধান তৈরি করে নিয়েছে। আল্লাহর শরীয়তের মুকাবেলায় নিজেদের পছন্দমতো এক শরীয়ত বানিয়ে নিয়েছে। (নাউযুবিল্লাহ)

এ বিবর্তন আসলে খুবই মারাত্মক বিচ্যুতি। প্রথম দুটোর বিবর্তনে দ্বীনকে সমূলে বাতিল করা হয়নি, কিন্তু বিকৃত বা বর্জন করা হয়েছে। কিন্তু তিন নম্বর শাখায় দ্বীনকে, দ্বীনের আহকামকে বা—দস্তুর বাতিল করে নতুন দ্বীন কায়েম করা হয়েছে। অথচ মানব জীবনে এ তিন ক্ষেত্র সর্বাধিক পরিব্যাপ্ত ও প্রকাশ্য—দৃশ্যমান বিষয়। যখন কোনো অনুসন্ধানী উম্মতের মাঝে দ্বীনী আহকামের বিষয়গুলোকে পরিপূর্ণ অসামঞ্জস্য অর্থাৎ, পুরো উল্টো অথচ নিজকে উম্মতে মুহাম্মদী বলে দাবী করছে। পরিমাপকারী বিস্মিত ও আক্ষেপের সঙ্গে বলবে “হে আল্লাহ! এরা কোন্ বিষয়ে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামÑএর সঙ্গে একমত? এরা কি করে উম্মতে মুহাম্মদী দাবি করছে? হে মুসলমান! এখনও কি নিজের অবস্থা সম্পর্কে সতর্ক হওয়া অর্থাৎ, নিজের অবস্থা শোধরানো অপরিহার্য নয়? যদি অপরিহার্য হয় তবে কখন থেকে শুরু হবে? উপরোক্ত বিষয়গুলোর কোন্টি অস্বীকার করার মতো? সাবধান! রোগ—চিকিৎসায় ব্যস্ততা যদি বাধা সৃষ্টি করে, তাহলে তো মৃত্যু অনিবার্য।

এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় হলো মুসলমানদের দ্বীনী অবক্ষয়ের সঙ্গে মুসলিম জাতির অধ:পতন ও ব্যর্থতার সম্পর্ক। কাজেই দ্বীনী অধ:পতন একটি আত্মিক ব্যাধি। দৈহিক রোগের যেমন বিশেষ কারণ থাকে, যেসব কারণ দূর করলে দৈহিক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, তেমনি আত্মিক রোগেরও বিশেষ বিশেষ কারণ রয়েছে। সেগুলো দূর করাই তার চিকিৎসা ব্যবস্থা ও নিরাময়ের পথ। তাই রোগ নিরূপণ করা হলো চিকিৎসার পূর্ব শর্ত।

রোগ যেমন বিভিন্ন রকম হয় তার চিকিৎসা ব্যবস্থাও ভিন্ন ভিন্ন হয়। স্থান—কাল—পাত্র বিশেষে ব্যবস্থা নিতে হবে। পুরুষ ও নারীদের জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা। মুসলিম জাতির আসল রোগ হলো দ্বীনী অজ্ঞতা অথবা স্বল্প জ্ঞান। আমলযোগ্য ফরযিয়্যাতের ইলম না থাকা এবং ইলম মোতাবেক আমল না করা, যার কারণ রূহানী দুর্বলতা, মহান আল্লাহর ভয় ও মুহাব্বত না থাকা। উল্লেখ্য, উম্মতের দ্বীনী দুর্বলতা দূরীকরণের জন্য জোরদার মেহনত করতে হবে। এ মেহনতে উলামা, তালাবা, সুলাহা ও জনসাধারণের সম্মিলিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

পুরুষের কর্মসূচি : মুসলমানগণের সন্তানদেরকে সর্বপ্রথম ঈমান—ইসলামের শিক্ষা দিতে হবে। তারপরে পার্থিব জরুরী ও বৈধ বিষয় সমূহের শিক্ষা দিতে কোনো বাধা নেই। যাতে করে একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার অর্থাৎ, সকল পেশাদারী সৎ নিষ্ঠাবান কর্তব্য পরায়ণ হয়। তখনই ইহকাল—পরকালে সফলতা লাভ হবে। দ্বীনী শিক্ষা প্রদান সন্তানের পিতা—মাতার উপর অপরিহার্য হক। অন্যথায় পিতা—মাতা সন্তানকে দ্বীন শিক্ষা দীক্ষা থেকে বঞ্চিত করলে উভয় জাহানে লাঞ্চিত ও বঞ্চিত হবে। ধনী স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানদেরকে দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য উৎসর্গ করবে। অবশ্য পার্থিব প্রয়োজনে অন্যান্য বৈষয়িক বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করতে হবে।

পুরুষ ও মহিলাদের জন্য দ্বীনী কর্মসূচি : বয়স্ক পুরুষগণ নিজেদের দ্বীনী দুর্বলতা দূর করার জন্য আলেম, তালেবে ইলমদের কাছে গিয়ে নিজ মাতৃভাষায় লিখিত মাসায়েলের কিতাব এক একটি বিষয় সবক নিয়ে শিক্ষা করবে। সুন্নাতের অনুসারী কোনো খাঁটি আলেমকে জিজ্ঞাসা করে কিতাব নির্বাচন করে নিবে। কিতাবটি এমন হওয়া চাই যার মধ্যে দ্বীনের প্রতিটি শাখা যেমন- আকাইদ, ইবাদাত, মু‘আমালাত, মু‘আশারাত ও আখলাক সম্পর্কিত বিধিনিষেধ পাওয়া যায়। যেমন- বেহেশতী জেওর, হায়াতুল মুসলিমীন, আদাবুল মু‘আশারাত, ছাফাইয়ে মু‘আমালাত ও তা‘লীমুস সুন্নাহ, এক মিনিটের মাদরাসা ইত্যাদি কিতাবের ধারাবাহিক তা‘লীম করতে হবে। কিতাবের বিষয়টি যতক্ষণ পর্যন্ত ভালোভাবে আয়ত্তে না আসবে ততক্ষণ বার বার পড়তে থাকবে। যেখানে বুঝে না আসে নিজের খেয়ালখুশী মতো না বুঝে বিজ্ঞ আলেমগণের নিকট থেকে বুঝে নিবে। যাদের অক্ষর জ্ঞান নাই তাদের দৈনিক অথবা সপ্তাহে কোনো আলেমকে দাওয়াত দিয়ে মজলিসে দ্বীনী বিষয়সমূহ শিখে নিবে। দ্বীনী শিক্ষক যদি বিনা টাকায় না পাওয়া যায়, তাহলে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে হলেও জরুরী বিষয়ের ইলম শিখতে হবে। মশকের মাধ্যমে নামাযে পঠিতব্য সুরাসমূহ সহীহ—শুদ্ধভাবে তিলাওয়াত শিখতে হবে। উলামা—মাশায়েখগণের মজলিস ও সোহবত নিজের উপর আবশ্যকীয় করে নিতে হবে। রূহানী দুর্বলতার জন্য বুযূর্গানে দ্বীনের সোহবত অবলম্বন করা নিজের উপর জরুরী করে নিবে।

মহিলাগণের কর্মসূচি : দ্বীনদার পরহেযগার শিক্ষিকা পাওয়া গেলে অথবা অল্পবয়স্কা মেয়েদেরকে তার সাহায্যে কুরআন মাজীদ ও ধর্মীয় বিষয়াদি শিক্ষা দেবে। তাদের জন্য বেহেশতী জেওরের দশ খণ্ড ও তা‘লীমুস সুন্নাহ, তা‘লীমুন নিসা, হায়াতুল মুসলিমীন কিতাবসমূহ ইনশাআল্লাহ যথেষ্ট হবে; বরং বেহেশতী গাওহার নামক একাদশ খণ্ডসহ তা পুরুষদের জন্যও যথেষ্ট হবে। যদি কোনো মহিলা শিক্ষিকা না পাওয়া যায়, তাহলে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
১. ঘরে যদি কোনো শিক্ষিত মাহরাম পুরুষ থাকে, তাহলে সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি সময় নির্ধারণ করে নিবে। এ সময় সবাইকে একত্রিত করে ধমীর্য় বই পড়ে শুনাতে থাকবে এবং বুঝিয়ে দিবে। এভাবে নেসাবের কিতাবসমূহ কয়েকবার খতম করবে।
২. মাঝে মাঝে কোনো বুযূর্গ আলেমকে বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে ওয়াজ শুনাতে থাকবে।
৩. মৃত্যুর চিন্তা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের মূলরোগ সাব্যস্ত করেছেন দুনিয়ার মোহগ্রস্থতা। যার ফলে আখেরাতের প্রতি উদাসীনতা ও গাফলতি সৃষ্টি হয়। আর তার প্রতিকার বলেছেন মৃত্যুর চিন্তা করা, মৃত্যুকালীন ও মৃত্যুপূর্বে মৃত্যুর পথযাত্রীর মৃত্যু অবস্থা নিজের মধ্যে চিন্তায় আনা। রূহ কবয থেকে জান্নাত কিংবা জাহান্নামে প্রবেশ পর্যন্ত অবস্থার মোরাকাবা করা। যেমনÑ মুনকার—নাকীরের সওয়াল—জওয়াব, কবর ও হাশরের আযাব ও নেয়ামতসমূহের হিসাব—নিকাশ, পুলসিরাত ইত্যাদি বিষয় নিয়ে দৈনিক কমপক্ষে ২০ বার ২০ মিনিট নির্জনতায় চিন্তা করা। হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি ২০ বার মৃত্যুর কথা স্মরণ করবে তার শহীদী মর্যাদা লাভ হবে।
মোরাকাবা ও মোহাসাবা : অধিকাংশ সময় এরূপ খেয়াল করবে যে, আমি আমার প্রভু মহান আল্লাহর সামনে আছি। আমার সমস্ত কাজ তিনি দেখছেন এবং সমস্ত কথা তিনি শুনছেন। তিনি আমার অন্তরের কল্পনা—জল্পনারও খবর রাখেন। এটাই মোরাকাবা।

মোহাসাবা : দিবা রাত্রের মধ্যে কোনো একটি সময় নির্জনে বসে সারা দিনের কৃতকর্মের হিসাব নেয়া। নির্জনে বসে এরূপ খেয়াল করবেÑএখনি আল্লাহর দরবারে আমার হিসাব নিকাশ হচ্ছে, আমি উত্তর দিতে সক্ষম হচ্ছি কি?
তাওবা ও ইস্তিগফার : যখনই কোনো গুনাহের কাজ হয়ে যায়, তখনই নির্জন স্থানে সেজদায় পড়ে নম্রতার সঙ্গে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। যদি কান্না আসে তবে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করবে। আর যদি কান্না না আসে, তবুও নিজের মাঝে কান্নার ভাব সৃষ্টি করবে। তাওবা করতে কখনও দেরি করবে না। কে বলতে পারে কখন মৃত্যু এসে জীবনলীলা সাঙ্গ করে দেয়?

আল্লাহর আইন শাশ্বত ও চিরন্তন

মহানবী জগতের আদর্শ মহামানব। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

মানব জাতির মুক্তি ও কামিয়াবী সুরাতুল আসরের ৪ মূলনীতির আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *