গৌরবময় ব্যক্তিত্ব । মূল : মাওলানা তাকী উসমানী
কিছুদিন আগে ইসলামী জাহানের যেসব অত্যন্ত মর্যাদাবান আলেমে দীন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, তাদের মধ্যে ভারতের প্রখ্যাত ফকীহ জনাব মাওলানা কাযী মুজাহিদুল ইসলাম কাসেমী নাম তালিকার শীর্ষে। তিনি আমাদের যুগের সেইসব গৌরবময় ব্যক্তিত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যাদের খেদমত কখনো ভুলে যাওয়ার মতো নয়।
হযরত মাওলানার নাম আমি সর্বপ্রথম ১৪০০ হিজরীর শেষ ভাগে শুনেছিলাম, যখন বড় ভাই হযরত মাওলানা মুফতী রফী উসমানী সাহেবের সাথে প্রথমবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সুযোগ পেয়েছিলাম। ডারবানে অবস্থানকালে সেখানকার মুসলমানরা মাওলানা মুজাহিদুল ইসলাম সাহেবের নাম অত্যন্ত সম্মানের সাথে উচ্চারণ করেন এবং জানালেন যে, তিনি কিছুকাল এখানে অবস্থান করে গিয়েছেন। মুসলমানরা তাঁর কাছে খুবই উপকার পেয়েছে। আমার প্রিয় বন্ধু মুহাম্মদ শুআইব উমর সাহেব (ডারবানের একজন বিশিষ্ট আইনজীবী, পরে তিনি আমাদের দারুল উলূম থেকে ইসলামী শিক্ষাও লাভ করেছেন।) হযরত মাওলানার কাছে বিশেষভাবে শিক্ষা নিয়েছিলেন এবং তাঁর কাছে উত্তরাধিকার আইন ভালোভাবে শিখে নিয়েছিলেন। তিনি বিশেষভাবে তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার স্বীকার ও তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। হযরত মাওলানার সাথে এভাবে পরোক্ষ পরিচয় তো হয়ে গিয়েছিল এবং তাঁর সাথে সাক্ষাতের আগ্রহও ছিল। কিন্তু তাঁর সাথে সাক্ষাত প্রথম হয় সেই সময়, যখন তিনি পাকিস্তানে শুভাগমন করেন। কয়েকবার সাক্ষাতের পরেই অনুমান করা গেল যে, তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সম্পর্কে অসাক্ষাতে যা কিছু শুনেছিলাম, তা আসলেই সত্য। হযরত মাওলানা ছিলেন ভারতের বিহার প্রদেশের বাসিন্দা। রাজধানী পাটনায় সেখানকার ওলামায়ে কেরাম ইমারাতে শরীয়া নামে ইসলামী বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি ছিলেন সেটার প্রাণপুরুষ।
জেদ্দায় মুনাজ্জামাতুল মুতামারিল ইসলামীর পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেটার অধিবেশনসমূহ যোগদানের সময় আমি অনুভব করলাম যে, তাতে ভারতের আলেমদের মধ্যে কেউ আমন্ত্রিত হন না। তাই আমি ওটার মহাসচিব শায়খ জেব বলখুজাকে বলে মাওলানা মুজাহিদুল ইসলাম কাসেমী সাহেবকে বিশেষভাবে আমন্ত্রিত করালাম। তারপর থেকে তিনি প্রতি বছর অধিবেশনে যোগ দিতেন। একবারও তিনি অনুপস্থিত থাকতেন না। এভাবে তাঁর সাথে বার্ষিক সাক্ষাতের একটি উপলক্ষও তৈরি হয়ে গেল। তিনি মাজমাউল ফিকহিল ইসলামীর কাজে বিশেষ আন্তরিকতার প্রকাশ ঘটাতেন, এজন্য নিবন্ধসমূহ লিখতেন, পর্যালোচনায় অংশ নিতেন এবং সম্মেলনে যেসব আরব আলেম অংশগ্রহণ করতেন, তাদের মধ্য থেকে বিশেষ মনীষীকে নিজের মাজমাউল ফিকহিল ইসলামীর সম্মেলনগুলোতে পালাক্রমে দাওয়াত দিতেন। এভাবে ক্রমে ক্রমে আরব আলেমদের মধ্যে হযরত মাওলানার পরিচিতি গড়ে ওঠে একজন জ্ঞানী গবেষক হিসেবে। ফলে আন্তর্জাতিক ফিকাহ একাডেমীর আরব আলেমদের মধ্যেও তাঁর বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা অর্জিত হয়।
প্রায় চার বছর আগের কথা। আমি হযরত মাওলানার অসুস্থতা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত খবর পেয়েছিলেন। বিস্তারিত কিছু জানতে পারিনি। বাহরাইনে মাজমাউল ফিকহিল ইসলামীর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। সেখানে তাঁর সাথে সাক্ষাত হয়। তখন তিনি বললেন, তার ক্যান্সাররোগ ধরা পড়েছে। শুনে আমি প্রায় কেঁপে উঠলাম। কিন্তু তিনি রোগটির কথা এমনভাবে বললেন যেন সর্দিকাশি হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ্, তাঁর চলনে বললে সেই রোগের কোন প্রভাব অনুভূত হচ্ছিল না। আমি তাঁর কাছে বিস্তারিত জানতে চাইলাম। তিনি বললেন- আল্লাহ তাআলা আমার প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন। ডাক্তার সাহেবরা তো এটাকে মরণব্যাধি সাব্যস্ত করেন এবং চিকিৎসায় তেমন লাভ হয় না বলেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলার দয়া ও মেহেরবানীতে আমার ব্যাপারে চিকিৎসা উপকারী প্রমাণিত হচ্ছে। আমাকে সফর থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। কিন্তু দেখুন, আমি দীর্ঘ সফর করে এখানে এসেছি এবং আলহামদুলিল্লাহ আমার জরুরী কাজ চালু আছে। তখনই তিনি আমাকে জানালেন যে, তিনি কাযী আল-ফোরকানী (৬৪৬ হি.) রহ.-এর কিতাব ‘সিনওয়ানুল কাযা ও উনওয়ানুল ইফতা’ এর টীকা লিখছেন। সেটার পাণ্ডুলিপি তখনো সফরে সাথে ছিল। তিনি বলতে লাগলেন, আমার কামনা বিচারব্যবস্থা সম্পর্কিত এ মূল্যবান কিতাবখানা আমার জীবদ্দশায় যেন প্রকাশিত হয়। তিনি আমাকে উক্ত কিতাবের ভূমিকা লেখার আদেশ দেন। কিতাবখানা দিল্লীর কাষীউল কুযাত বা প্রধান বিচারপতির লেখা এবং তা তখনো প্রকাশিত হয়নি। প্রথমবারের মতো তা হযরত মাওলানার টীকাসহ কুয়েতের আওকাফ মন্ত্রণালয় চারখণ্ডে প্রকাশ করে। কিতাবখানার প্রতি তাঁর অনুরাগ থেকে অনুমান করা যায় যে, তিনি প্রচণ্ড রোগে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও জ্ঞান গবেষণায় কত উঁচু মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। এরপরেও তিনি বড় বড় সফর করেন। সেই অবস্থায় আমেরিকায়ও গেলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায়ও।
মাওলানা মুজাহিদুল ইসলাম সাহেব শুক্রবার ৯ অক্টোবর ১৯৩৬ মোতাবেক ২০ শাবান ১৩৫৫ হিজরীতে বিহার প্রদেশের দরভাঙ্গা জেলার জালে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন বিহারে এবং ১৯৫৫ খৃস্টাব্দে দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেন। শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর ইঙ্গিতে তিনি ১৯৬৪ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত জামেয়া রাহমানিয়া মুঙ্গেরে দরসদানের দায়িত্ব পালন করেন। বিহারের আমীরে শরীয়ত হযরত মাওলানা মিন্নাতুল্লাহ রাহমানী ১৯৬১ এ তাঁকে ইমারতে শরীয়ার কাযী নিযুক্ত করেন এবং তারই মাঝখানে তিনি নায়েবে আমীরে শরীয়ত পদেও অধিষ্ঠিত থাকেন। ইমারতে শরীয়ার ব্যবস্থাপনা ফলপ্রসূ ও কার্যকর করতে তাঁর অবদান ভুলে যাওয়ার মতো নয়। তাছাড়া ১৯৭২-এ যখন ভারতের ওলামায়ে কেরাম মুসলিম পারসোনাল ল বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন, তখন হযরত মাওলানা ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। অবশেষে ২০০০-এ হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী কুদ্দিছা ছিররুহুর ইন্তেকালের পর তিনি সেটার সভাপতি মনোনীত হন। কিন্তু শেষ দিকে তার সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী (ভারত) যা ১৯৮৯-এ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং হযরত মাওলানার ওফাত পর্যন্ত সেটার তেরটি ফিকহী সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এগুলোর মাধ্যমে চল্লিশটি শিরোনামে গবেষণামূলক নিবন্ধ তৈরি করা হয় এবং প্রস্তাবসমূহ প্রকাশ পায়।
এপ্রিল ১৯৯৮ মোতাবেক জিলহজ্জ ১৪১৮ হি. থেকে তিনি লাগাতার মারাত্মক ব্যাধির শিকার ছিলেন। কিন্তু ১১ মার্চ ২০০২ মোতাবেক জিলহজ্জ ১৪২২ হি. পর্যন্ত তিনি নিজের কাজকর্ম চালু রাখেন। ১১ মার্চ রোগ প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়, দিল্লীর এপোলো হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয় এবং সম্ভব সব রকমের চিকিৎসা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ৪ এপ্রিল ২০০২ মোতাবেক ২১ মহররম ১৪২৩ হিজরী জুমআর রাতে মাগরিবের নামাযের অব্যবহিত পরেই তার সুনির্দিষ্ট সময় এসে যায় এবং তিনি সেই বরকতময় রাতে আপন প্রকৃত প্রভুর সান্নিধ্যে গিয়ে মিলিত হন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
আরো জানতে ভিজিট করুন আমাদের ওয়েব সাইট রাহে সুন্নাত ব্লগ