তালিবে ইলম-এর জন্য বিশেষ হিদায়াত
হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ. তাঁর যাযাউল আ‘মাল কিতাবে উল্লেখ করেছেন যে, দুনিয়াতেই গোনাহের ২৭ প্রকার ক্ষতি হয়। এর মধ্যে প্রথম ক্ষতি ইলমে দ্বীন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে যাওয়া। তাই বর্তমানে গোনাহের নিত্য-নতুন আসবাব উপকরণের ব্যাপক ব্যবহার, তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার, নিয়ন্ত্রণহীন অপসংস্কৃতির কু-প্রভাব দ্বীনী তালিবে ইলমদের উপরও পড়ছে। যার কারণে ইলম শিক্ষায় অনীহা বৃদ্ধি পাচ্ছে, স্মৃতি শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। এ রাস্তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছার পূর্বে অনেকেই ঝরে পড়ছে।
যারা জাতির ভবিষ্যৎ কান্ডারী, তাদের জন্য সঠিক দিক নির্দেশনা দেওয়া জরুরী। এমতাবস্থায় প্রয়োজনের তাকীদে তাদেরকেও কোন দ্বীনী মুরুব্বী ও আধ্যাত্মিক রাহবারের পরামর্শ অনুযায়ী চলা জরুরী।
১. তালিবে ইলম-এর জন্য সর্বপ্রথম নিয়্যত খালেছ করতে হবে। কেননা, ইলম অর্জন তখনই সাওয়াব ও আনুগত্যের কাজ হবে যখন তাতে কোন লোক দেখানো বা পার্থিব উদ্দেশ্য থাকবে না। একমাত্র উদ্দেশ্য হবে আল্লাহ তা‘আলাকে রাজি খুশি করা।
এতদ্বসংক্রান্ত নিচের হাদীসসমূহ খুবই গভীরভাবে অনুধাবন ও হৃদয়াঙ্গম করা উচিত।
ক. হাদীস শরীফে আছে যে, এ জন্য ইলম অর্জন করো না যে, তার দ্বারা আলেমদের সাথে গর্ব করবে। লোকদের সাথে বিবাদে লিপ্ত হবে কিংবা মজলিসের অধিকর্তা হবে। যে এমন করবে তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং ৭৭
খ. যে ইলম দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জন করা হয় সেটাই প্রকৃত ইলম। যেই ব্যক্তি উহা পার্থিব (অর্থাৎ দুনিয়ার) উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অর্জন করবে সে কিয়মাতের দিন জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।
গ. হাশরের ময়দানে প্রথমে নিয়তের আদালতে তিন ব্যক্তিকে হাজির করা হবে। তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি হবে যে ইলম শিখেছে, অন্যকে শিখিয়েছে এবং কুরআন পড়েছে। তাকে হাজির করে আল্লাহ তা‘আলা তার সব নিয়ামতের কথা তুলে ধরবেন। সে সবগুলো স্বীকার করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তুমি এত নিয়ামতের বিনিময়ে কি আমল করেছো?
সে উত্তর দিবে যে, আমি কুরআনের তিলাওয়াত শিখেছি অন্যকে শিখিয়েছি। এবং আপনার জন্য কোরআন পড়েছি। আল্লাহ তায়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো। বস্তুত তুমি ইলম শিখেছো যাতে তোমাকে আলেম বলা হয় এবং তিলাওয়াত করেছো যাতে তোমাকে ক্বারী বলা হয়। আর দুনিয়াতে তোমাকে এমনটি বলা হয়ে গেছে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা এর ব্যাপারে আদেশ করবেন; তার চেহারা মাটিতে হেঁচড়িয়ে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করো। -সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড. ১৯০৫
ঘ. হাশরের ময়দানে প্রত্যেক আদম সন্তানকে ৫টি প্রশ্ন করা হবে। এর মধ্যে একটি হবে, যতটুকু ইলম শিখেছিলে সে মুতাবেক কতটুকু আমল করেছো? সূতরাং খাঁটি মনে আমলের নিয়তে ইলম শিখতে হবে।
২. ইলম অর্জনে কানাআত তথা অল্পেতুষ্ট হওয়ার কোন সুযোগ নাই। হাদীসে পাকে আছে, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, দুই লুভাতুর অন্তর এমন যে, তারা কখনো পরিতৃপ্ত হতে পারে না।
এক. দুনিয়া অন্বেষী।
দুই. ইলম অন্বেষী।
কাজেই বর্তমান এই ফিতনা মহামারীর আকার ধারণ করেছে যে, কোন নাকেস পন্থা অবলম্বন করে কিভাবে আলেম নামধারী হওয়া যায়? একটা লক্বব হাসিল করাটাই মাকসাদ। শর্টকোর্স, তাদাখুল পদ্ধতি, নোট বই, গাইড বই পড়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে শুধু শ্রেণী ডিঙ্গানো; ইলমের গভীরতা অর্জনের কোন ফিকির নাই; যা দুনিয়াতে ইলমকে শূণ্যতার পর্যায়ে পৌঁছানোর একটি প্রতিযোগীতা।
৩. প্রকৃত ইলম নেক সোহবতের মাধ্যমে অর্জিত হয়। বিশিষ্ট ফকীহ আল্লামা শাতেবী রহ. তার আল-মুয়াফাকাত কিতাবে লিখেছেন “ইলম প্রথমে সংরক্ষিত ছিল মনীষীদের সীনায়, পরে তা চলে এসেছে বই-পুস্তকে, বরং তার চাবি রয়ে গেছে তাঁদেরই হাতে”।
ইমাম আবু হানীফা রহ. এর বিষয়টি তো খুবই প্রসিদ্ধ, তিনি একাধারে ১৮ বছর ফকীহুল ইরাক হাম্মাদ ইবনে আবু সুলাইমান রহ. এ সাহচার্য গ্রহণ করেন।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. হযরত ইসমাঈল ইবনে উলাইয়া রহ. এর সোহবতে নিয়মিত ১৩ বছর থেকেছেন।
এ যমানার হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতবী, ফকীহুন নফস মুফতী রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী, হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদুল মিল্লাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহীমাহুমুল্লাহ সাইয়্যেদুত তায়েফাহ হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ, এর সোহবতে ধন্য হয়েছেন।
তালিবে ইলমের জন্য আসলাফ-আকাবীরের সর্ব সম্মত পথ ও মত হলো যে, আহলেদিল আলেম বুযূর্গানে দ্বীনের সোহবত ও মুহাব্বত অপরিহার্য্য।
হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রহ. বলেন, কোন ‘বাকী বিল্লাহ’ ও ‘ফানা ফিল্লাহ’ ব্যক্তির সোহবত ছাড়া ইলমের মধ্যে নূর পয়দা হয় না। আর নূর বিহীন ইলম এমন, যেমন কি না অনেক সময় তোঁতা পাখীকে কুরআনের আয়াত বা ফার্সী কথা শেখানো হয়।
সূতারং ইলম অনুযায়ী আমলী যিন্দেগী গঠন করার চিকিৎসা একটাই আলেমে বা-আমলের সোহবত। সে যা বলে তার উপর নিজেও আমল করে।
দরসী কিতাবের সাথে মাদ্রাসার পাঠ্য তালিকায় ইসলাহী কিতাবাদী নেসাবের অর্ন্তভুক্ত করা সময়ের দাবী। নিচের কিতাবগুলো- হযরত থানভী রহ. কর্তৃক রচিত কসদুস সাবীল, তাবলীগে দ্বীন, হায়াতুল মুসলিমীন, যাযাউল আমাল, তালীমুল মুতাআল্লামীন, হযরত যাকারিয়া রহ. কর্তৃক রচিত আপ-বিতী, মুফতী আব্দুল মালেক দা:বা: কর্তৃক রচিত তালিবানে ইলম পথ ও পাথেয়, অধমের রচিত তালীমুস সুন্নাহ ও নেসাবে তালীমুস সুন্নাহ ইত্যাদি। নেসাবভুক্ত না হলে ব্যক্তিগত ভাবেও পাঠ করা আবশ্যক।
সকল ক্ষেত্রে সুন্নাতের ইহতেমাম করা ও প্রতিটি নেক আমলের শুরুতে এই নিয়্যত করা যেন আল্লাহর মুহাব্বত অন্তরে বৃদ্ধি পায়। সকল প্রকার জাহেরী, বাতেনী গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।
আরো জানতে ভিজিট করুন আমাদের ওয়েব সাইট রাহে সুন্নাত ব্লগ