তাসাওউফ ও আধ্যাত্মিক সাধনার আদব
দ্বীনের জন্যে আদব একটি মৌলিক বিষয়। আদব যে পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে সে অনুপাতে মানুষের দ্বীনদারীর হেফাযত হবে, মানব জীবনে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। আর যে পরিমাণ বেআদবী গোস্তাখী পাপকর্মের প্রতি নিভীর্কতা ও উদাসীনতা থাকবে, মানুষ দ্বীন হতে সে পরিমাণ বঞ্চিত ও সম্পর্কহীন হতে থাকবে। ইলম, আমল, ইসলাহে নফস ইত্যাদি সর্ব বিষয়ে শরীয়তে আদবের গুরুত্ব অপরিসীম। সার কথা হলো তাসাওউফ হলো আদবের নাম। আদবের মাধ্যমেই এ সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয়। একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, যার ভাগ্যে আদব জুটেছে সে সৌভাগ্যবান। আর আদব থেকে বঞ্চিতজন সত্যিই হতভাগা। আদব হলো মানুষের জন্য ঢাল স্বরূপ। আমিরুল মুমিনীন হযরত ওমর রাযি. বলেছেন, “প্রথমে আদব শিখ তারপর ইলম শিখ”।
কোন ফার্সী কবি খুব সুন্দর বলেছেন,
از خدا خواہيم توفيق ادب ۞ بے ادب محروم گشت از فضل رب
“মহান আল্লাহর দরবারে আদব—কায়দার জন্য তাওফীক প্রার্থনা করছি। কারণ, বেয়াদব তো আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ থেকে মাহরুম ও বঞ্চিত হয়ে যায়।”
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী রাযি. বলেছেন, “প্রত্যেকটা জিনিসেরই একটা মূল্য থাকে, মানুষের মূল্য নির্ণিত হয় তার ইলম ও আদবের বিচারে।”
প্রখ্যাত ফকীহ হযরত আবু লাইস সমরকন্ধী রহ. বলেছেন, ইসলামের পাঁচটি কিল্লা আছে, প্রথম কিল্লা হলো একীন ও বিশ্বাস, দ্বিতীয় কিল্লা হলো ইখলাস ও নিষ্ঠা, তৃতীয় কিল্লা হলো শরীয়তের ফরযসমূহ, চতুর্থ কিল্লা হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতসমূহ, আর পঞ্চম কিল্লা হলো আদব। মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত জীবনের সকল ক্ষেত্রে আদব মেনে চলবে ততক্ষণ পর্যন্ত শয়তান তার সম্পর্কে নিরাশ থাকে। আর যখন আদব ছেড়ে দেয় তখন শয়তান তাকে সুন্নাত ছাড়তে উৎসাহিত করে। অনন্তর ধীরে ধীরে ফরয, ইখলাস ও একীন শুন্য হয়ে পড়ে।
হযরত বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী রহ. বলেছেন আদব শূন্য ব্যক্তি স্রষ্টা ও সৃষ্টি উভয়ের দৃষ্টিতেই ঘৃণিত বলে বিবেচিত হয়।
সকল পথেরই কিছু আদব রয়েছে। যে কোনো পথের পথিকের জন্য রয়েছে কিছু নিয়ম—কানুন। পথিককে তার মনযিলে মাকসুদে পেঁৗছতে হলে যত্নের সাথে মেনে চলতে হয় সে সব নিয়মনীতি। যদি কোনো ব্যক্তি পথ চলতে গিয়ে সে পথের নিয়ম নীতির প্রতি ভ্রম্নক্ষেপ না করে তাহলে তাকে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পেঁৗছতে পথে পথে সম্মুখীন হতে হয় নানা জটিলতায়। নানা প্রকার বাধা বিঘ্নতায়। কখনও বা পথ হারিয়ে বিপথে উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াতে হয়। কখনও বা চোর ডাকাতের হাতে পড়ে সহায় সম্বল হারিয়ে পথে বসতে হয়। আল্লাহর পথের পথিকদেরও যাদেরকে “সালেকীনে তরীকত” বলা হয় তাদেরও কিছু পথ চলার নিয়ম কানুন আছে। সকল পথের রাজপথ হলো আল্লাহ পর্যন্ত পেঁৗছার পথ। এ পথ হলো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর সুন্নাতের অনুগামী আদবের পথ। এ পথ অবলম্বনের মাধ্যমেই সহজে মনযিলে মাকসুদে পেঁৗছা যায়।
এ পথে পথিকৃৎ হযরত সাহাবায়ে কিরাম রাযি. তাবেঈন, সলফে সালেহীন আমাদের আকাবিরীন।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
وَمَنْ يُّطِعِ اللهَ وَالرَّسُوْلَ فَأُولٰٓئِكَ مَعَ الَّذِيْنَ اَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّيْنَ وَالصِّدِّيْقِيْنَ وَالشُّهَدَآءِ وَالصَّالِحِيْنَ وَحَسُنَ أُولٰٓئِكَ رَفِيْقًا.
অর্থ : “যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে, তাঁরাই ঐ সব লোক যাদের প্রতি আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন। অর্থাৎ নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও সৎকর্মশীলগণ। আর তাঁদের সান্নিধ্যই হলো উত্তম।” -সুরা নিসা : ৬৯
এ পথের সালেক ও পথিক যদি সে সব নিয়ম—কানুনের অনুসরণ না করে, তাহলে তাকেও দিকভ্রান্তের মতো পূর্ণ জীবন পথে প্রান্তরে কাটিয়ে দিতে হয়। অনেক সময় তো রিপু ও শয়তানের ধেঁাকায় পড়ে ঈমান আমল থেকে বঞ্চিত হতে হয়। তাই মনযিল স্পর্শ করতে হলে এপথের নিয়মনীতির সর্বাত্মক অনুসরণ বুদ্ধিমান সালেকের জন্য অত্যন্ত জরুরী একটি বিষয়।