দ্বীনি ইলম শিক্ষা করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
দ্বীনি ইলম ছাড়া জাতিকে পথ প্রদর্শন করা সম্ভব নয়। যখন কোন জাতি অন্যায় ও অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে, তখনই আল্লাহ ঐ জাতির নিকট একজন নবীকে অহি-র জ্ঞানসহ পাঠিয়েছেন। জাহেলিয়াতের যুগে আরবরা লুটতরাজ, রাহাজানি, গোত্রকলহ, যেনা-ব্যভিচার সহ যাবতীয় অন্যায় ও পাপ কাজে লিপ্ত ছিল। বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ ২৩ বছরের নবুওয়াতী যিন্দেগীতে পর্যায়ক্রমে অহি-র জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষদেরকে জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে সঠিক পথের দিশা দিয়েছিলেন।
ইলমের সংজ্ঞা :
‘ইলম’ আরবী শব্দ العلم মাছদার থেকে উৎকলিত। অর্থالادراك والمعرفة বুঝা, উপলব্ধি করা। পারিভাষিক অর্থ, هو نور يقذفه الله فى قلب من يحبه يعرف به حقائق الاشياء وغوامضها ‘এটা এমন আলো, যা আল্লাহ তাঁর প্রিয় মানুষের অন্তরে ঢেলে দেন। অতঃপর তিনি তা দ্বারা বস্ত্তর তত্ত্ব ও রহস্য জানতে পারেন’।
দ্বীনি ইলমের গুরুত্ব :
আল্লাহ কর্তৃক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জিবরীল মারফত সর্বপ্রথম প্রত্যাদেশকৃত শব্দ হল, اِقْرَأْ ‘আপনি পড়ুন!। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বলেছিলেন, أَنَا بِقَارِئٍ ‘আমি পড়তে জানি না’। তখন জিবরীল (আঃ) তাকে জাপটে ধরেছিলেন। এই একই দৃশ্য তিনবার হওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট সূরা ‘আলাক্বের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাযিল হয়। বুখারী শরীফ হাদীস/৪৯৫৩ করুণাময় আল্লাহ তা‘আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অহি-র জ্ঞান শিক্ষা দেন। সুতরাং আমাদের সমাজ ও দেশ থেকে অন্যায়, অপকর্ম দূর করতে ইলমের গুরুত্ব অপরিসীম। ইলম অর্জনের নির্দেশনা স্বরূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ ‘প্রত্যেক মুসলিমের উপরে জ্ঞান অন্বেষণ করা ফরয। ইবনু মাজাহ হাদীস/২২৪; মিশকাত হাদীস/২১৮, সনদ হাসান।
‘সুতরাং এমন কেন হয় না যে, তাদের প্রত্যেকটি বড় দল হতে এক একটি ছোট দল বের হবে, যাতে তারা দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আর যাতে তারা নিজ কওমকে ভয় প্রদর্শন করতে পারে যখন তারা ওদের নিকট প্রত্যাবর্তন করে, যেন তারা সতর্ক হয়’ (তওবা ৯/১২২)।
দ্বীনি ইলম অর্জনের প্রতি আল্লাহর উৎসাহ প্রদান :
মানুষ অজ্ঞ-মূর্খ হয়ে পৃথিবীতে আসে। আল্লাহ বলেন, عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ ‘আমি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছি, যা সে জানত না’ (‘আলাক্ব ৯৬/৫)। ইলম বা জ্ঞান দ্বারা ভাল-মন্দ নির্ণয় করা যায়। এর দ্বারা অন্যায়ের প্রতিরোধ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব। সুতরাং আল্লাহ যার মঙ্গল চান এবং যার দ্বারা হক্বের বাস্তবায়ন সম্ভব তাকেই মহামূল্যবান জ্ঞান দান করে থাকেন। যেহেতু জ্ঞানের মালিক আল্লাহ, তাই এই জ্ঞান আল্লাহ যাকে চান তাকে দান করেন। তিনি বলেন, يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ ‘তিনি যাকে ইচ্ছা হিকমত দান করেন এবং যাকে হিকমত দান করা হয় তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয় এবং কেবল বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরাই শিক্ষা গ্রহণ করে’ (বাক্বারাহ ২/২৬৯)। এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِى الدِّينِ ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন’। -বুখারী শরীফ হাদীস নং-৭১
মানুষ ইলম অর্জন করবে, সে অনুযায়ী আমল করবে এবং নিজেদের মাঝে ইলম প্রচার করবে এটাই আল্লাহর দাবী। আর এ জন্যই আল্লাহ জ্ঞানার্জনের প্রতি উৎসাহিত করেছেন,
وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ.
‘সুতরাং এমন কেন হয় না যে, তাদের প্রত্যেকটি বড় দল হতে এক একটি ছোট দল বের হবে, যাতে তারা দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আর যাতে তারা নিজ কওমকে ভয় প্রদর্শন করতে পারে যখন তারা ওদের নিকট প্রত্যাবর্তন করে, যেন তারা সতর্ক হয়’ (তওবা ৯/১২২)।
জ্ঞানী ও মূর্খদের মধ্যে প্রার্থক্য :
ইলম আল্লাহ প্রদত্ত এক অফুরন্ত নে’মত। যা জ্ঞানী ও মূর্খদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ‘বলুন! যারা জানে এবং যারা জানে না তার কি সমান?’ (যুমার ৩৯/৯)। তিনি অন্যত্র বলেন, قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الْأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَمْ هَلْ تَسْتَوِي الظُّلُمَاتُ وَالنُّورُ ‘বলুন! অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান হতে পারে? আলো ও অন্ধকার কি এক হতে পারে?’ (রা‘দ ১৩/১৬)।
মহান আল্লাহ সম্পর্কে যারা সঠিক ধারণা রাখে এবং তার শারঈ বিধি-বিধান পরিপূর্ণভাবে জানে এবং মেনে চলে তারাই প্রকৃত জ্ঞানী। আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে মূলতঃ আলেমরাই তাঁকে ভয় করে’ (ফাতির ৩৫/২৮)। অন্যত্র তিনি বলেন, شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ‘আল্লাহ সাক্ষ্য প্রদান করেন যে, নিশ্চয়ই তিনি ব্যতীত কোন সত্য মা‘বুদ নেই এবং ফেরেশতাগণ ও ন্যায়নিষ্ঠ বিদ্বানগণ (সাক্ষ্য প্রদান করেন)। তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্য মা‘বুদ নেই। তিনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’ (আলে ইমরান ৩/১৮)। তিনি আরো বলেন, وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ رَبِّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ ‘পক্ষান্তরে যারা জ্ঞান ও বিদ্যায় অভিজ্ঞ তারা বলে, আমরা উহার প্রতি ঈমান এনেছি, সবই আমাদের রবের তরফ থেকে এসেছে। সত্য কথা এই যে, কোন জিনিস হতে প্রকৃত শিক্ষা কেবল জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন লোকেরাই গ্রহণ করে’ (আলে ইমরান ৩/৭)।
আলেমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী :
রক্ত সম্পর্ক কিংবা বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে কোন ব্যক্তির ওয়ারিছ হওয়া যায়। কিন্তু ইলম এমন একটি মূল্যবান সম্পদ, যে ব্যক্তি তা অর্জন করবে আল্লাহ তাকে নবীদের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী বানাবেন। সুতরাং আল্লাহ সম্পর্কে সঠিক ধারণাসম্পন্ন ব্যক্তিরা মূলতঃ নবীদের উত্তরাধিকারী। আর উত্তরাধিকার জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ الْعُلَمَاءَ هُمْ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ إِنَّ الأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا وَلاَ دِرْهَمًا إِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ.
‘আলেমরাই নবীগণের উত্তরাধিকারী। নবীগণ দীনার বা দিরহামের উত্তরধিকারী করেন না। বরং তারা ইলমের উত্তরাধিকারী করেন। ফলে যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করল সে বৃহদাংশ গ্রহণ করল। -ইবনু মাজাহ হাদীস/২২৩; সহীহুল জামে‘ হাদীস/৬২৯৭, সনদ সহীহ। অতএব দ্বীনি ইলম অর্জন করলে নবীদের উত্তরাধিকারী হওয়া যায়।
দ্বীনি ইলম অর্জনের মর্যাদা :
ইলম অর্জনের মর্যাদা অত্যধিক। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ
‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহ যাদেরকে জ্ঞান দান করেছেন তাদেরকে উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করবেন। তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত’ (মুজাদালাহ ৫৮/১১)।
ইলম অর্জনের মর্যাদা সম্পর্কে হাদীস শরীফে এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللَّهُ لَهُ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ. আবু হুরায়রা (রাযি.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ইলম হাছিল করার উদ্দেশ্যে পথ চলবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দিবেন। – তিরমিযী শরীফ হাদীস/২৬৪৬; ইবনু মাজাহ হাদীস/২২৩; সহীহুল জামে‘ হাদীস/৬২৯৮, সনদ সহীহ।
অন্য হাদীস শরীফে এসেছে,
عَنْ أَبِى أُمَامَةَ الْبَاهِلِىِّ قَالَ ذُكِرَ لِرَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم رَجُلاَنِ أَحَدُهُمَا عَابِدٌ وَالآخَرُ عَالِمٌ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِى عَلَى أَدْنَاكُمْ ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ اللَّهَ وَمَلاَئِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ حَتَّى النَّمْلَةَ فِى جُحْرِهَا وَحَتَّى الْحُوتَ لَيُصَلُّونَ عَلَى مُعَلِّمِ النَّاسِ الْخَيْرَ.
আবু উমামা আল-বাহিলী (রাযি.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে দু’জন লোকের কথা উল্লেখ করা হল। যাদের একজন আলেম অপরজন আবেদ। তখন তিনি বলেন, আলেমের মর্যাদা আবেদের উপর। যেমন আমার মর্যাদা তোমাদের সাধারণের উপর। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, নিশ্চয়ই তার প্রতি আল্লাহ রহমত করেন এবং তার ফেরেশতামন্ডলী, আসমান-যমীনের অধিবাসী, পিপিলিকা তার গর্তে থেকে এবং এমনকি মাছও কল্যাণের শিক্ষা দানকারীর জন্য দো‘আ করেন। -তিরমিযী শরীফ হাদীস/২৬৮৫; মিশকাত হাদীস/২১৩, সনদ হাসান।
عَنْ عَائِشَةَ أَنَّهَا قَالَتْ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ أَوْحَى إِلَيَّ أَنَّهُ مَنْ سَلَكَ مَسْلَكًا فِي طَلَبِ الْعِلْمِ سَهَّلْتُ لَهُ طَرِيقَ الْجَنَّةِ وَمَنْ سَلَبْتُ كَرِيمَتَيْهِ أَثَبْتُهُ عَلَيْهِمَا الْجَنَّةَ وَقَصْدٌ فِي عِلْمٍ خَيْرٌ مِنْ فَضْلٍ فِي عِبَادَةٍ.
আয়েশা (রাযি.) বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা আমার নিকট অহি প্রেরণ করেছেন এই মর্মে, যে ব্যক্তি ইলম হাছিলের লক্ষ্যে কোন পথ গ্রহণ করবে, তার জন্য আমি জান্নাতের পথ সহজ করে দেব এবং যার দু’চক্ষু আমি অন্ধ করেছি তার বদলে আমি জান্নাত দান করব। আর ইবাদত অধিক করার তুলনায় অধিক ইলম অর্জন করা উত্তম। -মিশকাত হাদীস/২৫৫; সহীহুল জামে‘ হাদীস/১৭২৭, সনদ সহীহ।
অন্যত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَطْلُبُ فِيهِ عِلْمًا سَلَكَ اللَّهُ بِهِ طَرِيقًا مِنْ طُرُقِ الْجَنَّةِ وَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ وَإِنَّ الْعَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِى السَّمَوَاتِ وَمَنْ فِى الأَرْضِ وَالْحِيتَانُ فِى جَوْفِ الْمَاءِ .
‘যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করার উদ্দেশ্যে কোন পথ অবলম্বন করে আল্লাহ তা‘আলা উহা দ্বারা তাকে জান্নাতের কোন একটি পথে পৌঁছে দেন এবং ফেরেশতাগণ ইলম অন্বেষণকরীর উপর খুশি হয়ে নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেন। এছাড়া আলেমদের জন্য আসমান ও যমীনের সকল অধিবাসী আল্লাহর নিকট দো‘আ ও প্রার্থনা করে। এমনকি পানির মধ্যে বসবাসকারী মাছও (তাদের জন্য দো‘আ করে)’। -আবু দাঊদ হাদীস/৩৬৪১; মিশকাত হাদীস/২১২; সহীহুল জামে‘ হাদীস/৬২৯৭, সনদ সহীহ।
জ্ঞানীদের জন্য করণীয় :
জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই করণীয় হল জানা বিষয়গুলো মানুষের নিকট প্রচার করা। যেমন আল্লাহ তাঁর নবীদের নিকট অহি প্রেরণের পর তা মানুষদের নিকট প্রচারের নির্দেশ দেন। আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ
‘হে রাসূল! পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন তবে আপনি তাঁর পয়গাম পৌঁছালেন না’ (মায়েদা ৫/৬৭)। এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, بَلِّغُوا عَنِّى وَلَوْ آيَةً ‘আমার পক্ষ হতে মানুষদের নিকটে পৌঁছে দাও, যদি একটি আয়াতও হয়’। -বুখারী শরীফ হাদীস/৩৪৬১; তিরমিযী শরীফ হাদীস/২৬৬৯।
পক্ষান্তরে আলেমরা দ্বীন প্রচারে অবহেলা করলে কিংবা বিরত থাকলে অবস্থা হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। হাদীস শরীফে এসেছে,
عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمِ يُجَاءُ بِالرَّجُلِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيُلْقَى فِى النَّارِ فَتَنْدَلِقُ بِهِ أَقْتَابُهُ فَيَدُورُ بِهَا فِى النَّارِ كَمَا يَدُورُ الْحِمَارُ بِرَحَاهُ فَيُطِيفُ
بِهِ أَهْلُ النَّارِ فَيَقُولُونَ يَا فُلاَنُ مَا لَكَ مَا أَصَابَكَ أَلَمْ تَكُنْ تَأْمُرُنَا بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَانَا عَنِ الْمُنْكَرِ فَقَالَ كُنْتُ آمُرُكُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَلاَ آتِيهِ وَأَنْهَاكُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَآتِيهِ.
‘ওসামা ইবনু যায়েদ (রাযি.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এক ব্যক্তিকে কিয়ামতের দিন নিয়ে আসা হবে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এতে করে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাবে। আর সে তা নিয়ে ঘুরতে থাকবে যেমনভাবে গাধা আটা পিষা জাঁতার সাথে ঘুরতে থাকে। জাহান্নামীরা তার নিকট একত্রিত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করবে, আপনি কি আমাদের ভাল কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ করতেন না? সে বলবে, হ্যাঁ। আমি তোমাদের ভাল কাজের আদেশ করতাম, কিন্তু নিজে করতাম না। আর খারাপ কাজের নিষেধ করতাম কিন্তু নিজেই তা করতাম। -বুখারী শরীফ হাদীস/৩২৬৭; মিশকাত হাদীস/৫১৩৯।
অতএব আমলবিহীন ইলম কিয়ামতের দিন বড় শাস্তির কারণ হবে। আরবী প্রবাদে রয়েছে, رجل بلا عمل كشجرة بلا ثمر
‘আমলবিহীন ব্যক্তি ফলবিহীন বৃক্ষের ন্যায়’।
জনৈক আরবী কবি বলেন, لو كان للعلم شرف من دون التقي* لكان أشرف خلق الله إبليس
‘যদি তাক্বওয়াবিহীন ইলমের কোন মর্যাদা থাকত, তবে ইবলীস আল্লাহর সৃষ্টিকুলের সেরা বলে গণ্য হত। -নবীদের কাহিনী, ১/১৩ পৃঃ।
দ্বীনি ইলম প্রচারে সতর্কীকরণ :
দ্বীনি ইলম প্রচারের ক্ষেত্রে সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রতিটি বিষয় উপস্থাপনের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, বিষয়টি কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী, না পরিপন্থী। কোন মনগড়া কথা উপস্থাপন করা যাবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে কোন কথা বৃদ্ধি করা যাবে না। কেননা তিনি হুঁশিয়ারী প্রদান করে বলেন, مَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ ‘যে ব্যক্তি আমার উপর ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যারোপ করে সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে করে নেয়। -বুখারী শরীফ হাদীস/৩৪৬১
অন্যত্র তিনি বলেন, مَنْ حَدَّثَ عَنِّى بِحَدِيثٍ يُرَى أَنَّهُ كَذِبٌ فَهُوَ أَحَدُ الْكَاذِبِينَ ‘যে ব্যক্তি আমার পক্ষ হতে এরূপ কথা বলে, যা সে মনে করে যে, সেটা অসত্য। সে মিথ্যাবাদীদের অন্তভুর্ক্ত। -মুসলিম শরীফ, মিশকাত হাদীস/১৯৯
দ্বীনি ইলম প্রচারে লৌকিকতার কুফল :
ইলম প্রচার হবে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। এতে কোন প্রকার লৌকিকতা থাকবে না। যদি নিয়ত ঠিক থাকে তাহলেই ইলম প্রচারে নেকী পাওয়া যাবে। নিয়ত সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ ‘নিয়তের উপর সকল কাজ নির্ভরশীল’।-বুখারী শরীফ হাদীস/১, ৫০৭০
আরো কঠিন বিষয় হ’ল কোন বিষয় জানার পর প্রচারের সাথে সাথে আমল করতে হবে। নচেৎ কিয়ামতের মাঠে তা বিপদজনক হয়ে দাঁড়াবে। হাদীস শরীফে এসেছে,
وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ وَقِرَاءَةَ الْقُرْآنِ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ، فَقَالَ: مَا عَمِلْتَ فِيهَا ؟ قَالَ: تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ وَقَرَأْتُ الْقُرْآنَ وَعَلَّمْتُهُ فِيكَ، قَالَ: كَذَبْتَ، إِنَّمَا أَرَدْتَ أَنْ يُقَالَ: فُلَانٌ عَالِمٌ وَفُلَانٌ قَارِئٌ فَقَدْ قِيلَ، فَأُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ
‘যে ব্যক্তি ইলম শিখেছে এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছে এবং কু্রআন পাঠ করত, কিয়ামতের মাঠে তাকে উপস্থিত করা হবে। আল্লাহ প্রথমে তাকে নিজ প্রদত্ত নে‘মতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন আর তারও স্মরণ হবে। তখন আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন, এই সকল নে‘মতের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তুমি কী করেছ? সে বলবে, আমি ইলম শিখেছি এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছি। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি ইলম শিখেছ ও অপরকে শিক্ষা দিয়েছ এ উদ্দেশ্যে যে, তোমাকে আলেম বলা হবে। আর কুরআন তেলোয়াত করেছ এ উদ্দেশ্যে যে, তোমাকে ক্বারী বলা হবে। আর তোমাকে তা বলাও হয়েছে। তারপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হবে। অতঃপর তাকে মুখের উপর ভর করে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। -মুসলিম শরীফ হাদীস/৫০৩২; হাকেম হাদীস/২৫২৪; মিশকাত হাদীস/২০৫
দ্বীনি ইলম নিয়ে অহংকার করার পরিণাম :
আল্লাহ তা‘আল সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী। তিনি বলেন, إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’ (লুকমান ৩১/২৭)।
আর তিনি মানুষকে অতি অল্পই জ্ঞান দান করেছেন। তিনি বলেন, وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا ‘তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৮৫)।
আল্লাহর জ্ঞান সর্ম্পকে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর জ্ঞানের পরিসীমা সম্পের্কে খিজির (আঃ) মূসা (আঃ)-কে বলেছিলেন, يَا مُوسَى مَا نَقَصَ عِلْمِى وَعِلْمُكَ مِنْ عِلْمِ اللَّهِ إِلاَّ كَنَقْرَةِ هَذَا الْعُصْفُورِ فِى الْبَحْرِ ‘হে মূসা! আমার ও তোমার জ্ঞানের স্বল্পতা আল্লাহর জ্ঞানের নিকট সমুদ্রের মধ্যে এই চড়ুইয়ের ঠোঁটের এক ফোটা পানির সমান। -বুখারী শরীফ হাদীস/৭৪,৭৮
মূসা (আঃ) একদা বনী ইসরাঈলদের মধ্যে বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালেন। তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হল, সবচেয়ে জ্ঞানী কে? তিনি বললেন, আমি সবচেয়ে জ্ঞানী। মহান আল্লাহ তাকে সতর্ক করে দিলেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁর নিকটে অহী প্রেরণ করলেন। দুই সমুদ্রের সংগমস্থলে আমার বান্দাদের মধ্যে একজন বান্দা রয়েছে, যে তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী। -বুখারী শরীফ হাদীস/৭৪, ১২২
অহংকারের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُورًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিক আত্মঅহংকারীকে পসন্দ করেন না’ (নিসা ৪/৩৬)।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ الْجَوَّاظُ وَلاَ الْجَعْظَرِىُّ ‘অহংকারী ও অহংকারের মিথ্যাভানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না’। -আবু দাউদ হাদীস/৪৮০১, সনদ সহীহ। সুতরাং ইলমের অহংকার না করে এর পরিসীমা আল্লাহর দিকে সোপর্দ করাই উত্তম।
দ্বীনি ইলম প্রচারে কৃপণতা করা ও গোপন করার শাস্তি :
ইলম প্রচারের ক্ষেত্রে কৃপণতা করা বাঞ্চনীয় নয়। কেননা কোন ব্যক্তি যদি তার অপর কোন ভাইকে কল্যাণকর কোন বিষয় শিক্ষা দেয় অতঃপর সে অনুযায়ী যদি সে আমল করে তাহলে আমলকারীর ন্যায় সেও অনুরূপ নেকী পাবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ عَلَّمَ عِلْمًا فَلَهُ أَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهِ لاَ يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الْعَامِلِ
‘যে ব্যক্তি কাউকে দ্বীনি ইলম শিক্ষা দিবে সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় ছাওয়াব পাবে, যে তার উপর আমল করল। কিন্তু আমলকারীর নেকী থেকে এতটুকুও কমানো হবে না। -ইবনু মাজাহ হাদীস/২৪০; সহীহুল জামে‘ হাদীস/৬৩৯৬, সনদ হাসান।
স্মরণ রাখতে হবে যে, ইলম গোপন করা যাবে না। কোন ব্যক্তি যদি ইলম গোপন করে, তার পরিণতি সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ سُئِلَ عَنْ عِلْمٍ عَلِمَهُ ثُمَّ كَتَمَهُ أُلْجِمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِلِجَامٍ مِنْ نَارٍ
‘কোন ব্যক্তিকে তার জানা বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তা যদি সে গোপন করে তাকে কিয়ামতের মাঠে আগুনের বেড়ি পরানো হবে। -তিরমিযী শরীফ হাদীস/২৬৪৯; মিশকাত হাদীস/২২৩, সনদ সহীহ।
সাহাবীগণ হাদীস গোপন করাকে অত্যাধিক ভয় করতেন। একদা মু‘আয (রাযি.) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সওয়ারীর সাথে ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ডেকে বললেন, যে ব্যক্তি অন্তর থেকে সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বুদ নেই তার জন্য জাহান্নাম হারাম হয়ে যাবে। তখন মু‘আয (রাযি.) মানুষদের মাঝে এই উক্তিটি প্রকাশ করতে চাইলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নিষেধ করলেন। এ জন্য যে, মানুষ এই বাক্যের উপর নির্ভরশীল হবে। কিন্তু মু‘আয (রাযি.) মৃত্যুর পূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসটি গোপন হওয়ার ভয়ে বর্ণনা করেছিলেন। -বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মিশকাত হাদীস/৪৫
আল্লাহর নিকট উপকারী ইলমের প্রার্থনা করা :
আল্লাহর নিকট ইলমসহ যাবতীয় কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করতে হবে। আল্লাহর নিকট চাওয়ার মাধ্যমে ইলম অর্জিত হলে তা দিয়ে দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই অর্জন করা সম্ভব। আর যদি না চাওয়াতেই ইলম আসে, তা দিয়ে দুনিয়া সম্ভব আখিরাত কখনই অর্জন করা সম্ভব নয়।
আল্লাহ বলেন, مَنْ يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ
‘অনেকে বলে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতে দান কর। অথচ তার জন্য পরকালের কোন অংশ নেই’ (বাক্বারাহ ২/২০০)।
আর এজ্যই নবী রাসূলগণ একমাত্র আল্লাহর নিকটেই চাইতেন। যেমন ইবরাহীম (আ)-এর প্রার্থনা করে বলেন, رَبِّ هَبْ لِي حُكْمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে প্রজ্ঞা দান কর এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত কর’ (শু‘আরা ২৬/৮৩)।
অনুরূপ মুসা (আঃ) আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছিলেন।
আল্লাহ বলেন, رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي– وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي– وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِنْ لِسَانِي– يَفْقَهُوا قَوْلِي
‘হে আমার পালনকর্তা! আমার বক্ষকে প্রশস্ত করে দাও, আমার কাজকে সহজ করে দাও এবং আমার জিহবা থেকে জড়তা দূর করে দাও, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে’ (ত্বহা ২০/২৫-২৮)।
আর এরই ধারাবাহিকতায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নিকট উপকারী ইলমের প্রার্থনা করতেন। হাদীস শরীফের ভাষায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি ফজর ছালাতের পর প্রার্থনা করতেন এ বলে যে,
اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا وَرِزْقًا طَيِّبًا وَعَمَلاً مُتَقَبَّلاً
‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট উপকারী জ্ঞান, কবুলযোগ্য আমল ও পবিত্র রূযী প্রার্থনা করছি’। -মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, তাবারানী, মিশকাত হাদীস/২৪৯৮। সুতরাং আমাদের সকলেরই উচিত একমাত্র আল্লাহর নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করা।
শিক্ষার্থীদের জন্য করণীয় :
শিক্ষার্থীকে অবশ্যই অধ্যয়নে মনযোগী হতে হবে এবং রুটিন মাফিক চলতে হবে। শরীরের প্রতি যত্নবান হতে হবে। জামা-কাপড়, বেডসীট, পড়ার টেবিল ইত্যাদি পরিষ্কার ও গোছালো রাখতে হবে। কোন ছাত্রের স্মৃতি হ্রাস পেলে তার জন্য অতীব জরূরী বিষয় হ’ল স্বীয় মন্দ কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর নিকটে তওবা করা। এ বিষয়ে ইমাম শাফেঈর ঘটনা অনস্বীকার্য। ইমাম শাফেঈ তার মুখস্থ না হওয়ার ব্যাপারে স্বীয় শিক্ষককে বলেছিলেন, شكوت إلى وكيع سوء حفظي– فأرشدني إلى ترك المعاصي
‘আমি অভিযোগ করলাম ওয়াকীর (ইমাম শাফেঈর শিক্ষক) নিকটে আমার মুখস্থ না হওয়ার ব্যাপারে, তিনি আমাকে উপদেশ দিয়ে বলেন, পাপ কাজ ছেড়ে দাও। -ফাতাওয়ে ইসলাম সাওয়াল জওয়াব, ১ম খন্ড পৃষ্ঠা ৩২৩০
শিক্ষার্থীরা শিক্ষকবৃন্দকে জিজ্ঞেস করবে, যা সে বুঝতে পারবে না। এরূপ কাজ আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং জিবরীল (আঃ)-এর মধ্যকার প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে শিক্ষা নিতে পারি। তাছাড়া আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
‘অতএব তোমরা যদি না জান, তবে আহলে যিকরের নিকট থেকে জেনে নাও’ (নাহল ১৬/৪৩; আম্বিয়া ২১/৭)।
শিক্ষার্থীদের বর্জনীয় বিষয় সমূহ :
শিক্ষকদের অবাধ্য হওয়া, তাদের সামনে উচ্চ স্বরে কথা বলা ও রূঢ় আচরণ করা, বড়দের অসম্মান, ছোটদের সাথে খারাপ ব্যবহার, সহপাঠীদের কষ্ট দেওয়াসহ যাবতীয় অন্যায় কাজ বর্জন করতে হবে। অপচয়-অপব্যয় থেকে বিরত থাকতে হবে। সেটা সময়, টাকা-পয়সা বা যে কোন বিষয়ে হতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا-إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ
‘কিছুতেই অপব্যয় কর না। নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই’ (বনী ইসরাঈল ১৭/২৬-২৭)।
অসৎসঙ্গ ত্যাগ এবং সৎসঙ্গ গ্রহণ করতে হবে, তাতে দুনিয়াতে মঙ্গল এবং আখেরাতে আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাওয়া যাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, وَرَجُلاَنِ تَحَابَّا فِى اللَّهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ
‘দু’জন ব্যক্তি, যারা পরস্পর ভালবাসে আল্লাহর জন্য এবং একত্রিত হয় আল্লাহর জন্য এবং পৃথক হয় আল্লাহর জন্যই। -বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মিশাকাত হাদীস/৭০১
দ্বীনি ইলম অন্বষণে হিংসা :
হিংসা করা মহাপাপ। হিংসা করার পরিণতি ভয়াবহ। এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, إِيَّاكُمْ وَالْحَسَدَ فَإِنَّ الْحَسَدَ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ
‘তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাক। কেননা হিংসা মানুষের পূর্ণ আমলগুলো বিনষ্ট করে যেমন আগুন কাঠকে ভষ্মিভূত করে। -আবু দাউদ, মিশকাত হাদীস/৫০৪০
ইলম অন্বেষণের ক্ষেত্রে হিংসা করা জায়েয। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
لاَ حَسَدَ إِلاَّ فِى اثْنَتَيْنِ رَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ مَالاً فَسُلِّطَ عَلَى هَلَكَتِهِ فِى الْحَقِّ وَرَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ الْحِكْمَةَ فَهْوَ يَقْضِى بِهَا وَيُعَلِّمُهَا
‘কেবল দু’টি বিষয়ে হিংসা করা যায়। এক. সেই ব্যক্তির উপর, যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন অতঃপর তা বৈধ পন্থায় অকাতরে ব্যয় করার ক্ষমতা দিয়েছেন। দুই. সে ব্যক্তির উপর, যাকে আল্লাহ প্রজ্ঞা দান করেছেন অতঃপর সে তার মাধ্যমে বিচার ফায়ছালা এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়। -বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মিশাকাত হাদীস/২০২
কিয়ামতের পূর্বমুহূর্তে শিক্ষার অবস্থা :
কিয়ামতের প্রাক্কালে দুনিয়াবী শিক্ষা বৃদ্ধি পাবে এবং দ্বীনি শিক্ষা লোপ পাবে। মানুষের মাঝে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিশৃঙ্খলা বেড়ে যাবে। এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّ اللَّهَ لاَ يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا ، يَنْتَزِعُهُ مِنَ الْعِبَادِ ، وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ ، حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا ، اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالاً فَسُئِلُوا ، فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ ، فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا
‘আল্লাহ তাঁর বান্দাদের থেকে ইলম ছিনিয়ে নিবেন না। বরং দ্বীনের আলেমদের উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে ইলমকে উঠিয়ে নিবেন। তখন কোন আলেম অবশিষ্ঠ থাকবে না। যার দরুন লোকেরা মূর্খদেরকেই নেতা বানিয়ে নিবে, তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হলে তারা না জেনে ফাতওয়া প্রদান করবে। ফলে তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হবে এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে। -বুখারী শরীফ, হাদীস/১০০
অন্যত্র তিনি বলেন, إِنَّ مِنْ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ أَنْ يُرْفَعَ الْعِلْمُ ، وَيَثْبُتَ الْجَهْلُ ، وَيُشْرَبَ الْخَمْرُ ، وَيَظْهَرَ الزِّنَا
‘কিয়ামতের কিছু আলামত হ’ল, ইলম হরাস পাবে, অজ্ঞতা প্রসারতা লাভ করবে, মদ পানের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে এবং যেনা-ব্যভিচার বিস্তার লাভ করবে। -বুখারী শরীফ, হাদীস/৮১, ৫২৩১
দ্বীনি ইলম শিক্ষা করার সফলতা :
গোটা বিশ্ব আজ অশান্তিতে পুঞ্জিভূত। এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র হাতিয়ার হল দ্বীনি ইলম শিক্ষা। কেননা দ্বীনি ইলম অর্জনের মাধ্যমে দুনিয়াতে যেমন মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে ও সমাজে শান্তি আসবে, তেমনি আখেরাতের পাথেয় অর্জনের পথ সুগম হবে। মৃত্যুর পর মানুষের আমল বন্ধ হয়ে যায় অথচ দ্বীনি ইলম অর্জন করে শিক্ষা দিলে তা কবরে পৌছানোর অন্যতম একটি মাধ্যম হিসাবে পরিগণিত হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ
‘যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি আমল ব্যতীত। এই তিনটি আমল হ’ল, প্রবহমান ছাদাক্বা, এমন ইলম যা দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় এবং এমন সুসন্তান যে তার জন্য দো‘আ করে। -মুসলিম শরীফ হাদীস/১৬৩১
পরিশেষে :
বর্তমান সমাজ প্রকৃত শিক্ষাকে ভুলে কুশিক্ষার দিকে ধাবমান। সন্তান পিতা-মাতাকে, পিতা-মাতা সন্তানকে, ছোট ভাই বড় ভাইকে, এক মুসলিম অপর মুসলিমকে অপমান-অপদস্ত করতে সামান্য পরিমাণ দ্বিধাবোধ করে না। মুসলিমরা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে প্রতিটি জায়গায় নিপীড়নের শিকার। পৃথিবীতে অশান্তির দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলছে। এর প্রকৃত কারণ প্রকৃত শিক্ষাকে ভুলে যাওয়া। তাই বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে যদি প্রকৃত শিক্ষা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সমন্বয় করা হয় তাহলে অল্প সময়ের মধ্যে গোটা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তাই আসুন! অভ্রান্ত সত্যের চূড়ান্ত উৎস পবিত্র কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা গ্রহণ করে দুনিয়াতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করি এবং আখেরাতের পাথেয় সঞ্চয় করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!
ভাষান্তর : আবু তাসনীম উমাইর
কুরআনুল কারিমের কথা প্রবন্ধটি পড়তে ক্লিক করুন
আরো জানতে ভিজিট করুন আমাদের ওয়েব সাইট রাহে সুন্নাত ব্লগ