পবিত্র হজ্জের ঐতিহাসিক পটভূমি
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَكَفٰى وَسَلَامٌ عَلٰى عِبَادِهِ الَّذِيْنَ اصْطَفٰى اَمَّا بَعْدُ فَاَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ : وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ . وقال أيضا وَلِلّٰهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلا وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ وَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ حَجَّ لِلّٰهِ فَلَمْ يَرْفُثْ، وَلَمْ يَفْسُقْ، رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ
মহান আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টির দুই হাজার বছর পূর্বে বাইতুল্লাহ শরীফের স্থান নির্ধারণ করে ফেনার ন্যায় পানির উপর ভাসমান রেখে ছিলেন। অতঃপর সর্বপ্রথম ফেরেশতারা কাবাগৃহ নির্মাণ করে তাওয়াফ শুরু করেন।
অতঃপর কালের চক্রে হযরত নূহ আলাইহিস সালামের যুগে মহাপ্লাবনে কাবাঘর বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার পরবর্তীতে জনমানবহীন প্রান্তে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সপরিবারে হিজরত করে প্রভুপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে—বাপ, বেটা কাবা শরীফ পুননির্মাণ করেন।
পবিত্র হজ্জ হচ্ছে ইসলামের চতুর্থ স্তম্ভ। আরাফাতের ময়দানে ৯ জিলহজ্জ বিশ্ব মুসলিমের যে বিশাল সমাবেশ সৃষ্টি হয় পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মে এতোবড় সমাবেশ দেখা যায় না। বিশ্বের বিভিন্ন গোত্র এবং বর্ণের, বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মহামিলন ঘটে হজ্জের মৌসুমে পবিত্র মক্কা নগরীতে। নেই মানুষে মানুষে ভেদাভেদ।
দু’প্রস্থ সাদা কাপড় পরিধান করে প্রত্যেকটি মানুষের মুখে একটিমাত্র ধ্বনি উচ্চারিত হয়। লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা, ওয়ান নি‘মাতা লাকা ওয়াল মুলক লা শারীকা লাক।
মক্কার জমিনে পৃথিবীর সকল ভাষাভাষী মানুষের মুখে একটি আওয়াজ, একটি বুলি। মিনা, আরাফাহ, মুযদালিফা এ লাব্বাইকের ধ্বনিতে একাকার হয়ে যায়। আরব—অনারব লাব্বাইকার ধ্বনিতে অবিচ্ছেদ্য এবং অভিন্ন হয়ে যায়। ধনী গরিব, রাজা—বাদশাহর কোনো তফাত থাকে না। সবাই যেন গোলামীর বেশে মহামিলনের জন্য এগিয়ে যাচ্ছে।
সত্যিই পবিত্র হজ্জ মানব জাতিকে এবং তার প্রতিনিধিকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পবিত্রতম স্থান খানায়ে কাবায় একত্রিত ও ঐক্যবদ্ধ করে। এতে এক আত্মা অনুভূত হয়। মুসলিম ভ্রাতৃত্ব সুদৃঢ় এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
বরকতময় পবিত্র কাবার সামনে প্রতিটি মানুষ যেন নিজ পরিবারের সমাজের এবং রাষ্ট্রের প্রতিনিধি। সে যেন মহান আল্লাহর ঘর ধরে সবার গোনাহ মাফ চেয়ে নিচ্ছে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ কামনা করছে।
ঈমানদার, সুস্থ, স্বাধীন, সামর্থবান সবার উপর এই হজ্জ ফরয করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে-
وَلِلّٰهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيْلًا
যাদের ওই ঘর পর্যন্ত পৌঁছার স্বচ্ছলতা রয়েছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে তার উপর বাইতুল্লাহর হজ্জ করা ফরয। -সূরা আল—ইমরান : ৯৭
সামর্থ্যবানদের খানায়ে কাবার হজ্জ সম্পাদনের পেছনে যে যৌক্তিক বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দেয়, এই ঘরের রেঞ্জের ভেতরে চতুর্দিকের এরিয়ায় হরম সীমানায় কোনো অপরাধী প্রবেশ করলে কা’বা তাকে চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণ করে এবং মক্কার মুকাররমার পবিত্র ভূমি তার গুনাহসমূহ চুষে নিয়ে তাকে নিষ্পাপ মাসুম করে দেয়। পবিত্র কাবার সামনে পৌঁছলে মানুষের মনের মধ্যে এত বেশি বিনয় ও নম্রতা সৃষ্টি হয় যে, তার প্রতি অঙ্গে শিহরণ জাগে।
তার প্রত্যেকটি শিরা—উপশিরা অবনমিত হয়। পৃথিবীর মোহ, লোভ—লালসা ভুলে গিয়ে প্রতিটি মানুষ পবিত্র মক্কা নগরীতে জান্নাতের পরিবেশ উপভোগ করতে থাকে। মহান আল্লাহর অসীম মুহাব্বাতে পাগলপাড়া হয়ে সে কাবা গৃহের চতুর্দিকে চক্কর কাটতে থাকে, মনে হয় যেন সে মহান আল্লাহর দেয়ানা আশেক।
এই ঘরের দেয়ানা আশেকদের এজন্যই হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আবু কুবাইস পাহাড়ে চড়ে হজ্জের দাওয়াত দিয়েছিলেন।
وَ اَذِّنْ فِی النَّاسِ بِالْحَجِّ یَاْتُوْكَ رِجَالًا وَّ عَلٰی كُلِّ ضَامِرٍ یَّاْتِیْنَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِیْقٍۙ ۲۷
‘আর আপনি হজ্জের জন্য মানুষদেরকে বলে দিন যেন মানুষেরা হেঁটে (হজ্জে) আসে এবং সব ধরনের দুর্বল উটের পিঠে সওয়ার হয়ে আসে। পৃথিবীর চতুর্দিক থেকে দূরদূরান্তের পথ থেকে। যাতে তারা উপস্থিত হতে পারে তাদের কন্যাণময় স্থানে। -সূরা হজ্জ : ২৭
আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. নিজ তাফসীর গন্থে লিখেছেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যখন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে পবিত্র বাইতুল্লাহর হজ্জের জন্য মানুষকে আহ্বানের নির্দেশ দিলেন তখন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বললেন, হে আমার রব, কিভাবে আমি মানুষের কাছে আহ্বান পৌঁছাব? তাদের কাছে আমার আওয়ায যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা বললেন, আপনি আহ্বান করুন, পৌঁছানোর দায়িত্ব আমার।
হাদীস শরীফে এসেছে, যাদের কর্ণকুহরে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের হজ্জের দাওয়াত পৌঁছেছে এবং যারা লাব্বাইক বলেছে, মহান আল্লাহ তাদের পবিত্র ঘরের জন্য হজ্জ নসীব করেন। আল্লাহর ঘর কাবা শরীফকে কেন্দ্র করে দুটি ইবাদত বিধিবদ্ধ। নামায এবং তওয়াফ। জগতের যে কোনো প্রান্ত থেকে বাইতুল্লাহমুখী হয়ে নামায পড়া যায় তবে তওয়াফ করতে হলে বাইতুল্লাহর কাছে যেতে হয় এবং বাইতুল্লাহর কাছে তওয়াফ করতে হয়।
তওয়াফে বাইতুল্লাহ আল্লাহ প্রেমিক বান্দা—বান্দির জন্য অনিন্দ্য সুন্দর তাৎপর্যময় আমল। প্রভুপ্রেমের চূড়ান্ত নিদর্শন হলো তাওয়াফ। মুমিন জীবনের পরম কাক্সিক্ষত স্বপ্ন হলো বাইতুল্লাহর তওয়াফ করতে পারা। ঐতিহাসিকভাবে তওয়াফ, বাইতুল্লাহ নির্মাণের সূচনাকাল থেকেই প্রমাণিত।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- وَطَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّائِفِيْنَ وَالْقَائِمِيْنَ وَالرُّكَّعِ السُّجُوْدِ
অর্থাৎ, আমার ঘরকে তওয়াফকারী এবং রুকুকারী এবং সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো। -সূরা হজ, আয়াত : ২৬
এর দ্বারা বুঝা যায় যে, বাইতুল্লাহ তওয়াফ করার বিধান হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের যুগে আরোপিত ছিল।
এই হজ্জ জীবনে একবার ফরয হয়। পবিত্র এ হজ্জ পালনের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয়ের পাশাপাশি দৈহিক ও মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একটি মকবুল হজ্জের জন্য হাজী সাহেবদের প্রচেষ্টার শেষ থাকে না। হজ্জের মতো এই পুণ্যময় ফরয ইবাদতটি যার নসিব হয়, তার মতো ভাগ্যবান মানুষ কম আছে।
কেননা সে তার ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের সার্বিক কল্যাণ লাভে সক্ষম হয়। কাজেই হজ্জের এ মহান ইবাদতের সুযোগ অনেক হাজীর ক্ষেত্রে জীবনের সার্বিক কল্যাণ লাভে সক্ষম হয়। কাজে আজ হজ্জের এই মহান ইবাদত পালনের মাধ্যমে সুষমামণ্ডিত হয়ে আল্লাহ পাকের দরবারে মঞ্জরী লাভের উপযোগী হওয়া একান্ত কাম্য। আর এজন্য হজ্জের যাবতীয় নিয়ম—কানুন জানা দরকার।
এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি হজ্জের প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহু তায়ালা। হজ্জ তিন প্রকার : যথা- ১. হজ্জে তামাত্তু ২. হজ্জে কিরান ৩. হজ্জে ইফরাদ।
হজ্জে তামাত্তু : এতে দু’টি ইহরাম পৃথকভাবে বাঁধতে হয়। প্রথমে শুধু মীকাত থেকে ওমরার ইহরাম বাঁধতে হয়। অতঃপর হজ্জের সময় মক্কা শরীফ থেকে পুনরায় হজ্জের ইহরাম বাঁধতে হয়। হজ্জে তামাত্তুতে ওমরা এবং হজ্জ স্বতন্ত্রভাবে আদায় করতে হয়।
হজ্জে কিরান : কিরান হজ্জে মীকাতের পূর্ব থেকে একসাথে ওমরা এবং হজ্জ পালনের নিয়তে ইহরাম বাঁধতে হয়।
হজ্জে ইফরাদ : মীকাতের পূর্ব থেকে শুধু হজ্জের নিয়তে ইহরাম বাঁধতে হয়।
এবার হজ্জের ফরযসমূহ জেনে নিই।
১. হজ্জ আদায়ের নিয়তে ইহরাম বাঁধা (তামাত্তু হাজী মক্কা শরীফ থেকে হজ্জের নিয়ত করবেন আর কিরান ও ইফরাদকারী হাজী মীকাতের পূর্ব থেকে হজ্জের ইহরাম বাঁধবেন।
২. ৯ই যিলহিজ্জাহ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা অর্থাৎ ৯ই জিলহজ্জের দ্বিপ্রহরের পর থেকে পরবর্তী সুবহে সাদিক (ফরয) পর্যন্ত কোনো এক সময়ে আরাফাতে কিছুক্ষণ অবস্থান করা।
৩. তওয়াফে যিয়ারত করা।
প্রকৃত অর্থে হজ্জের ফরযসমূহ পালন ও ওয়াজিবসমূহ আদায় করা মহান আল্লাহর সামনে নিজেকে নিবেদিত করে দেয়া। প্রভুপ্রেমে বিলীন করে দেয়া। গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে হজ্জের মধ্যে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের অপূর্ব নজীর পাওয়া যায়।
কারো কোনো গর্ব নেই, নেই কোনো অহংকার, পোশাকের বাহাদুরি নেই, বংশের গৌরব নেই, নগ্ন মস্তকে এক প্রস্থ সেলাইবিহীন সাদা কাপড় পরিধান করে আর এক প্রস্থ গায়ে দিয়ে, একই বেশে আবর্তিত হয় প্রভুভক্ত আল্লাহর বান্দাগণ। তেমনিভাবে হজ্জ আদর্শ জীবন গঠনে মাইলফলকও বটে। কেননা হজ্জের প্রতিটি কর্মে রয়েছে অনুসরণীয় শিক্ষা।
দুঃখজনক হলেও বাস্তব সত্য হজ্জের কর্মকাণ্ড শেষ করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ হজ্জের প্রকৃত শিক্ষা হতে বহু দূরে সরে পার্থিব জীবনকে মূল লক্ষ্য বানিয়ে ফেলেছে এবং দীন ধর্মকে পেছনে ফেলে পার্থিব আরাম আয়েশে মত্ত হয়ে পড়েছে। অথচ এমটি কাম্য ছিল না। সুতরাং আসুন আমরা হজ্জের ঐতিহাসিক পটভূমিকে সামনে রেখে এ পবিত্র আমলের মূল চেতনায় অনুপ্রাণিত হই। কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধপ্রতিরোধ গড়ে তুলি। আমীন।
আরো জানতে ভিজিট করুন আমাদের ওয়েব সাইট রাহে সুন্নাত ব্লগ
যে মহিলা বে-পর্দা চলতে অভ্যস্ত তার জন্যও পর্দা আবশ্যক
বিবাহের পর কনে তুলে নেওয়ার আগে পর্দা রক্ষা করা কি জরুরী?