মদীনার জীবনে ইহুদীদের ষড়যন্ত্র
সৈয়দ আলী আহসান
রাসূলে খোদার মক্কায় যে জীবন ছিল— সে জীবনে তিনি অবিশ্বাসী কুরায়শগণের মুখোমুখী হয়েছিলেন । আঘাতের পর আঘাত এসেছে, কিন্তু তিনি ধৈর্য ধারণ করেছেন এবং প্রতিঘাত করেন নি। সংকল্পের দৃঢ়তা এবং বিশ্বাসের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নবদীক্ষিত মুসলমানগণ ক্রমশ সংঘবদ্ধ হতে লাগলেন, তবুও এক সময় আল্লাহর নির্দেশে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মদীনায় হিজরত করতে হল। হিজরতের সঙ্গে সঙ্গে জীবন যে শান্তিময় হল তা নয়। এখানে এসে তিনি সর্বতোভাবে চেষ্টা করলেন মানুষের জীবন থেকে কুফর এবং শিরক দূর করবার জন্য। মদীনা ছিল এ কর্মব্যবস্থাপনার উপযুক্ত ক্ষেত্র। প্রতিরোধ ছিল প্রবল এবং তা প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছিল। আঘাতও তেমনি কঠোর ছিল। অবশেষে সত্যের জয় এবং মিথ্যার অবসান হলো।
মদীনায় যে শক্তি তাঁর বিরুদ্ধে উদ্যত ছিল সেটি হচ্ছে ইহুদীদের শক্তি। রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহুদীদের বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করতে চেয়েছেন এবং তাদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু ইহুদীরা তাঁকে আন্তরিকভাবে কখনও গ্রহণ করতে পারেনি। তারা যদিও একজন পয়গম্বরের অপেক্ষায় ছিল, যখন সে পয়গম্বর তাদের সামনে উপস্থিত হলেন তিনি বনি ইসরাইল গোত্র থেকে এলেন না- ইহুদীরা এটা মেনে নিতে পারেনি। ইহুদীদের সঙ্গে রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শান্তিতে বসবাস করার জন্য চুক্তি করলেন ঠিকই, কিন্তু ইহুদীরা চুক্তি অনবরত ভঙ্গ করেই চললো। মদীনায় এসে রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি কর্তব্য হিসেবে মনে করেছিলেন যে, ইহুদীদের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হলেই শান্তি আসবে এবং তিনি কুরায়শদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে পারবেন। সে কারণেই যাতে মুসলমান এবং ইহুদী উভয়েরই নিরাপত্তা রক্ষিত হয় সে মর্মে তিনি একটি চুক্তি করলেন। চুক্তির সারমর্ম ছিল নিম্নরূপ :
১. দিওত বা রক্তপণ এবং ফিদিয়া বা মুক্তিপণের যে নিয়ম পূর্বে প্রচলিত ছিল এখনও তা বলবৎ থাকবে।
২. ইহুদীদের ধর্মীয় স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকবে। তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যাপারে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করা হবে না।
৩. ইহুদী এবং মুসলমানগণ পরস্পর সখ্যতা সূত্রে আবদ্ধ থাকবে।
৪. ইহুদী অথবা মুসলমানদের মধ্যে যে কোন পক্ষই অপর কোন এক শক্তির সঙ্গে যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়লে অন্য পক্ষ তাকে সাহায্য করবে।
৫. কোন পক্ষই কুরায়শগণকে আশ্রয় দিতে পারবে না।
৬. মদীনা আক্রান্ত হলে উভয় পক্ষই পরস্পরকে সহযোগিতা করবে।
৭. শত্রুর সঙ্গে এক পক্ষ সন্ধি করলে অপর পক্ষও সন্ধিতে শরীক থাকবে। কিন্তু ধর্মযুদ্ধ সম্পর্কে এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে না ।
মদীনার ইহুদীগণ চুক্তির কথা জানলেও বিভিন্ন সময়ে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে নানা ধরনের ধর্মীয় বিতর্কে জড়িত হতে চাইত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল জটিল প্রশ্ন করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বিব্রত করা এবং প্রমাণ করবার চেষ্টা করা যে তিনি আল্লাহর প্রেরিত নবী নন। আরেকবার রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে মদীনার এক শস্যক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। রাসূলের হাতে খেজুর শাখার একটি লাঠি ছিল। এখানে কতিপয় ইহুদীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হয়। এদের মধ্যে একজন কোনরূপ প্রস্তাবনা ছাড়াই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রশ্ন করল, “আপনি বলবেন কি রূহ কাকে বলে?” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর করলেন : “কুলির রূহু মিন আমরি রাব্বী।” – উত্তরটি আল্লাহর তরফ থেকে ওহী হিসেবে সে মুহূর্তেই অবতীর্ণ হয়েছিল। এর অর্থ হল; “বলে দাও রূহ আমার প্রতিপালকের আদেশ।” ইহুদীরা তখন বলতে বাধ্য হল আমাদের তৌরাতেও তাই আছে। ইহুদীরা আবার জিজ্ঞেস করল, “বলতে পারেন কি কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে?” আল্লাহর তরফ থেকে এর উত্তরও সঙ্গে সঙ্গে এল: “কুল ইন্নামা ইলমুহা ইন্দা রাব্বী।” এর অর্থ: “আপনি বলে দিন এ বিষয়ে একমাত্র জ্ঞান আমার প্রতিপালকের রয়েছে।”
অন্য এক সময় দুজন ইহুদী রাসূলকে জিজ্ঞেস করল : “তৌরাতে আছে ‘এবং আমি মূসাকে নয়টি স্পষ্ট নিদর্শন দান করেছি। এই নয়টি নিদর্শন কি?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গে সঙ্গে উত্তর করলেন;
১. আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুর শরীক করো না;
২. ব্যভিচার করো না;
৩. আল্লাহ্ যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন তাকে ন্যায়বিচার ব্যতীত হত্যা করো না;
৪. চুরি করো না;
৫. জাদু করো না;
৬. হত্যা করবার উদ্দেশ্যে নির্দোষ ব্যক্তিকে কোন ক্ষমতাশালী ব্যক্তির নিকট উপস্থিত করো না;
৭. সুদ খেয়ো না;
৮. সতী স্ত্রীলোককে ব্যভিচারের অপবাদ দিও না এবং
৯. শনিবার অর্থাৎ সাবাত সম্বন্ধে তোমরা আল্লাহর আদেশের সীমালংঘন করো না।”
ইহুদীরা তখন বললো, “আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি নবী।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, “তাহলে ইসলাম গ্রহণ থেকে কেন বিরত থাকছ?” তখন তারা বলল, “যদি আমরা ইসলাম গ্রহণ করি ইহুদীরা আমাদের হত্যা করবে।”
আরেকবার কতিপয় ইহুদী নবুয়তের নিদর্শন জানবার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেস করল, “আপনার নিদ্রা কিরূপ?” তিনি উত্তর করলেন: “আমার নিদ্রা তোমাদের নিদ্রার মত নয়। আমার চক্ষু সুপ্তিমগ্ন হয় বটে কিন্তু আমার কলব সদা জাগ্রত থাকে।“ ইহুদীরা বুঝতে পারল তিনি ঠিকই বলেছেন। তা সত্ত্বেও তারা ঈমান আনল না। এভাবে ইহুদীরা অনবরত প্রশ্ন করে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বিব্রত করবার চেষ্টা করত। কিন্তু নিজেরা শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করত না।
ইহুদীদের বনি কায়নুকা গোত্রের লোকেরা ব্যবসায়ী ছিল। তারা স্বর্ণালংকার প্রস্তুত করত এবং তাদের মধ্যে লোহার কাজে দক্ষ কামারও ছিল। একদিন এক বেদুঈন মুসলমান রমণী বনি কায়নুকা গোত্রের বসত বাড়িগুলোর কাছে একটি স্বর্ণালঙ্কারের দোকানে কিছু অলঙ্কার নির্মাণের জন্য এল। মহিলার মস্তক এবং মুখমণ্ডল আবরিত ছিল। দোকানের স্বর্ণকার এবং আশেপাশের ইহুদীরা বেদুঈন রমণীকে ঠাট্টা করতে লাগল। তার আবরণ উন্মোচন করতে বলল এবং পিছন থেকে একজন ইহুদী গিয়ে তার মস্তকের আবরণ খুলে ফেলল। এই ঘটনা একজন আনসারের চোখে পড়ল। সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে রমণীর সম্ভ্রম বাঁচাবার চেষ্টা করল এবং যে ইহুদী বেদুঈন রমণীর আবরণ খুলে ফেলেছিল তাকে হত্যা করল। ইহুদীরা তখন সম্মিলিতভাবে আনসারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তাকে হত্যা করল। আনসারের পরিবারবর্গ হত্যার প্রতিশোধ দাবি করল এবং কায়নুকা গোত্রের ইহুদীদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হল। ইহুদীরা তাদের চুক্তির সনদ মত রাসুলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে সংঘর্ষ বন্ধ করার দাবি জানাতে পারত কিন্তু তারা না করে তাদের পূর্বতন মিত্র ইব্ন উবাই এবং উবাদাহ ইব্ন সামিতকে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে বলল এবং নিজেরা আপন এলাকার অভ্যন্তরে আশ্রয় নিল। বনি কায়নুকার এলাকাটি দুর্ভেদ্য ও সুরক্ষিত ছিল। ইহুদীরা আশা করেছিল উবাই এবং উবাদাহ তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে, কিন্তু তারা এগিয়ে এলো না।
মুসললমানরা এদিকে বনি কায়নুকার এলাকার চতুর্দিক বেষ্টন করে ফেলেছে এবং সেই বেষ্টনী ভেদ করে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা যেমন সম্ভবপর ছিল না তেমনি বাইরে থেকে সাহায্য আসাও সম্ভবপর ছিল না। তখন ইব্ন উবাই রাসূলে খোদার কাছে এসে বনি কায়নুকা গোত্রের লোকদের প্রতি সদ্ব্যবহার দাবি করল। ইবন উবাইয়ের ধারণা হল যে, বনি কায়নুকা গোত্রের সকল লোককে বোধ হয় হত্যা করা হবে। সে বলল, “বনি কায়নুকার লোকেরা আমাকে সবসময় রক্ষা করেছে। আপনি কি তাদের হত্যা করবেন?” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি তাদের প্রাণদণ্ড দেব না।” সাহাবাদের সাথে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হল যে, বনি কায়নুকার সকল লোককে তাদের সম্পদ ও বাসস্থান পরিত্যাগ করে চিরকালের জন্য মদীনা ত্যাগ করে চলে যেতে হবে। তিনি উবাদাহকে পথপ্রদর্শক হিসেবে বনি কায়নুকার লোকদের সঙ্গে যেতে বললেন। মদীনার বাইরে উত্তর-পশ্চিম দিতে ওয়াদিলকুরা বলে একটি ইহুদী বসতি ছিল। তারা সেখানেই গিয়ে প্রথমে আশ্রয় নিল। পরে সিরিয়ার সীমান্তে বসতি স্থাপন করল। বনি কায়নুকার লোকেরা ধাতব দ্রব্যের ব্যবসা করত। তারা স্বর্ণালঙ্কার বানাত, রৌপ্যের অলঙ্কার বানাত এবং লোহা দিয়ে কৃষির যন্ত্রপাতি বানাত। এ সমস্ত ব্যবসার উপকরণ তারা ফেলে যেতে বাধ্য হল। এগুলো পেয়ে আনসার ও মুহাজিরগণ খুবই উপকৃত হন।
বনি কায়নুকার বহিষ্কারের পর মদীনার ইহুদীদের শক্তি অনেক খর্ব হয়ে গেল । যে বিচক্ষণতার সঙ্গে রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহুদীদের বিরোধিতার সম্মুখীন হলেন এবং বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিলেন রাজনৈতিক দিক দিয়ে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইহুদীদের বহিষ্কারের পর মদীনার অভ্যন্তরীণ বিভাজন কমে এল। খাযরাজ ও আউস গোত্রের মধ্যে যারা ইহুদীদের সাহায্যে ইসলামের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করার সাহস পাচ্ছিল তারা তখন দুর্বল হয়ে পড়ল। পাশ্চাত্যের সমালোচকরা মদীনা থেকে ইহুদীদের বহিষ্কার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি অন্যায় সিদ্ধান্ত বলে সাব্যস্ত করেছেন। এর উত্তর সহজেই দেয়া যায়। একজন রমণীর অপমান আরবদের কাছে তাদের জাতিগত অহঙ্কারের উপর প্রচণ্ড আঘাতের মত। দ্বিতীয়ত রমণীর মর্যাদা রক্ষার্থে আনসার পুরুষটি একজন ইহুদীকে হত্যা করেছিল । তৃতীয়ত, ইহুদীরা চুক্তি ভঙ্গ করে আনসার যুবককে হত্যা করেছিল। এর ফলে একটি যুদ্ধ হতে পারত। কিন্তু রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রক্তপাত বন্ধ করার জন্য এবং ভবিষ্যত সংঘর্ষকে সমূলে উৎপাটন করবার জন্য ইহুদীদের বহিষ্কার করেছিলেন। এটা ছিল তাঁর বিস্ময়কর ন্যায়পরায়ণতার নিদর্শন। ১৯১৪ সালে সারাজেভোতে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ নিহত হওয়ায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে গিয়েছিল। সমগ্র ইউরোপের খ্রীস্টানরা এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল । অন্যদিকে রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মদীনায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমান, ইহুদী ও মুনাফিকদের একই শহরে একত্রে বসবাস অসম্ভব বলে বিবেচনা করে যথেষ্ট রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে ইহুদীদের বহিষ্কারের আদেশ দিয়েছিলেন।
ইসলামের ইতিহাসে আমরা লক্ষ্য করি যে, ইহুদীরা মুসলমানদের সঙ্গে চুক্তি করেছে, আবার চুক্তিভঙ্গ করে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। হিজরতের পর ইহুদীদের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ্র সর্বপ্রথম যে চুক্তি হয় তাতে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার শর্ত ছিল। আমরা দেখেছি, বনি কায়নুকা গোত্রের লোকেরা কি করে তাদের শর্ত ভঙ্গ করলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে তাদের অপরাধের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করেছেন, কিন্তু তারা নতুন করে চুক্তিতে আবদ্ধ হতে স্বীকৃত হল না। ফলে তারা নির্বাসিত হল। বনি নাজির বলে আরেকটি ইহুদী গোত্র মদীনায় বসবাব করত। এরা ছিল খায়বরের একটি গোত্র। এরাও চুক্ত ভঙ্গ করেছিল। তারা মৃড়যন্ত্র করেছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যা করবার জন্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই প্রতারক দলকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, “আমার এ নগর থেকে তোমরা বহিষ্কৃত হও। তোমাদের মত জঘন্য মনোবৃত্তির লোক আর মদীনায় বাস করবে না।” বনি নাজিররা প্রথমে মদীনা ত্যাগ করতে সম্মত হয়নি, তারা যুদ্ধ চাইল। যুদ্ধে অবশ্য তারা পরাজিত হল। শেষ পর্যন্ত তারা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হলো।
মদীনায় এরপর রয়ে গেল বনি কুরায়জা নামক ইহুদী গোত্র। এরা অত্যস্ত বিত্তবান এবং অস্ত্রশস্ত্রে বলবান ছিল। মদীনার একটি বিরাট এলাকা জুড়ে সংঘবদ্ধ হয়ে বসবাস করতো। এদের গৃহগুলো ছিল দুর্গের মত দুর্ভেদ্য। এরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে মদীনায় বসবাস করছিল। কিন্তু খন্দকের যুদ্ধের সময় এরা চুক্তিভঙ্গ করে এবং কুরায়শদের পক্ষে যোগদান করে। কিন্তু তাদের হিসেবে ভুল হয়েছিল। খন্দকের যুদ্ধে কুরায়শরা পর্যুদস্ত হয়েছিল। আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরায়শদের ধ্বংস নেমে এল। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টিতে কুরায়শদের সমস্ত তাঁবু উড়ে গেল, অশ্বগুলো হ্রেষাধ্বনি করতে লাগল এবং উটগুলো আর্তনাদ করতে লাগল। বৃষ্টির সঙ্গে ছিল প্রচণ্ড শব্দ এবং বিদ্যুতের লেলিহান শিখা। কুরায়শদের তাঁবুর কোন চিহ্ন রইল না। তাদের সমস্ত অগ্নি নির্বাপিত হল এবং হাজার হাজার মানুষ সিক্ত মাটিতে একে অন্যকে জড়িয়ে উষ্ণতা পাবার চেষ্টা করতে লাগল। আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরায়শদের উপর যে ধ্বংস নেমে এসেছিল তার ফলে কুরায়শরা চিরকালের জন্য অথর্ব হয়ে গেল। মুসলমানগণ পরিখার যুদ্ধের পর অত্যন্ত ক্লান্ত এবং শ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। তাঁদের বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তবুও তারা বিশ্রাম নিল না। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে হযরত আলী (রা)-র নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী বনি কুরায়জার বসতি অবরোধ করল।
এই অবরোধকালে মুসলমানদের একমাত্র আহার্য ছিল খেজুর। এই খেজুর সরবরাহ করতেন হযরত সায়াদ ইব্ন উবাদা। এ কঠোর অবরোধের ফলে দুর্গের অভ্যন্তরের ইহুদীরা দুর্বল হয়ে পড়ে। তাদের মনে ভয়েরও সঞ্চার হল। কাব এবং উবাই উপলব্ধি করল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবরোধ ছাড়বেন না। ইহুদীদের যুদ্ধ করে বাঁচবার চেষ্টা করতে হবে এবং সে ক্ষেত্রেও তাদের জয়ের সম্ভাবনা নেই। কাব সকলকে বলল, “আমরা এখন মহাবিপদের সম্মুখীন। এই বিপদ থেকে মুক্তির তিনটি উপায় আছে, এই তিনটির যেকোন একটিকে বেছে নেয়া যেতে পারে। বর্তমানে এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি নবী। তৌরাতে আমরা তার কথা পাঠ করে থাকি। তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে আমরা নিজেদের রক্ত, সম্পদ, নারী ও শিশুকে রক্ষা করতে পারি। একমাত্র হিংসার বশবর্তী হয়ে তোমরা তাকে নবী বলে অস্বীকার করছ। কেননা তিনি তোমাদের বংশধারার নন। মূলত সন্ধি করে সন্ধি ভঙ্গ করা তোমাদের গুরুতর অপরাধ হয়েছে।
কাবের মত শুনে ইহুদীরা বললো, “আমরা তৌরাত পরিত্যাগ করব না এবং মূসার আইন কখনও লংঘন করব না।” কাব তখন বলল, “আরও একটি পথ আছে, চলো আমরা আমাদের নারী ও শিশুদের হত্যা করে উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে মুহাম্মদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হই। মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। যদি নিশ্চিহ্ন হতে হয় তবু পরিপূর্ণভাবেই হব। দুনিয়ার বুক থেকে চিরকালের জন্য উঠে যাব, কিন্তু আমাদের সন্তানদের নির্যাতনের মুখে রেখে যাবো না।” কাব বলল, “চলো তা হলে আক্রমণ করি। আজ শনিবারের রাত্রি, শনিবারে আক্রমণের সম্ভাবনা নেই। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে সম্ভবত মুসলমানগণ নির্ভাবনায় রয়েছে। সুতরাং এই সুযোগে অতর্কিতে আক্রমণ করে তাদেরকে পর্যুদস্ত করে দেই।” তখন তারা বলল, ‘শনিবারের অমর্যাদা আমরা করব না। আমাদের পূর্বপুরুষরাও এই দিনের অমর্যাদা কখনও করেননি।” তখন আমর ইব্ন সায়াদ বলে উঠল, “চুক্তি ভঙ্গ করে তোমরা মুহাম্মদের বিরোধিতা করেছ। এটা ভয়ঙ্কর একটি প্রতারণা। এই প্রতারণা আমি সমর্থন করতে পারি না। যদি মুহাম্মদের উপর ঈমান আন তবে সেটাই হবে সর্বাপেক্ষা উত্তম কাজ। অবশ্য মুহাম্মদ সেটা করবেন কিনা জানি না।” তারা তখন বলে উঠলো, “জীবন রক্ষার জন্য জিযিয়া দেব এ কখনও হতে পারে না। তার চাইতে প্রাণ দেওয়াই শ্রেয়।” আমর তখন বলল, “তাহলে তোমাদের সঙ্গে আমার আর কোন সম্পর্ক রইল না।”
একথা বলে সে দুর্গ থেকে বেরিয়ে এলো এবং রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দ্বাররক্ষী মুহাম্মদ ইব্ন মাসলামার কাছে উপস্থিত হল। মাসলামা তাকে বেরিয়ে যেতে দিলেন এবং সে মসজিদে নববীতে রাত্রি যাপন করল। কিন্তু তারপর আর তাকে কখনও দেখা যায় নি। এখনও পর্যন্ত কেউ জানে না সে কোথায় গেল এবং কিভাবে তার মৃত্যু হল । রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, “তাঁকে আল্লাহ্ তাঁর বিশ্বাসের জন্য বাঁচিয়ে দিয়েছেন।” অন্য একজন ইহুদী, যার নাম ছিল রিফা ইব্ন সামওয়াল, প্রহরীদের দৃষ্টিকে কৌশলে এরিয়ে সালমা বিনতে কায়েসের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল এবং সেখানেই সে ইসলাম কবুল করে।
পরের দিন বনি কুরায়জা তাদের দুর্গের দ্বারগুলো উন্মোচন করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আত্মসমর্পণ করল। পুরুষদের একপাশে সারিবদ্ধভাবে জড়ো করা হল এবং মহিলা ও শিশুদের অন্য পাশে। পুরুষদের সকলের হাত পিঠমোড়া করে বাঁধা হল। রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনি কায়নুকার প্রাক্তন রাবাঈ বা ইহুদী ধর্মযাজক আবদুল্লা ইব্ন সালামকে এদের দায়িত্বে নিযুক্ত করলেন। দুর্গের অভ্যন্তর থেকে সকল অস্ত্রশস্ত্র, বর্ম, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং গৃহের সামগ্রী বের করে এনে এক জায়গায় জড়ো করা হল। মদভর্তি পাত্রগুলো এবং খেজুরের সাজানো খামিরা ফেলে দেয়া হল ।
আউস গোত্রের লোকেরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে একটি প্রতিনিধি পাঠালেন। তাঁদের আবেদন ছিল যে, রাসূল যেন তাদের পুরাতন সাহায্যকারী বনি কুরায়জা গোত্রের সঙ্গে কিছুটা সদয় ব্যবহার করেন, যেমন তিনি খাযরাজ গোত্রের সহায়তাকারী বনি কায়নুকার প্রতি করেছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিনিধি দলকে জিজ্ঞেস করলেন, “বনি কুরায়জার বিচারের ভার তোমাদের কারও উপর যদি ছেড়ে দেই কেমন হয়?” তারা এতে রাজী হল। তখন তাদের গোষ্ঠী প্রধান সাদ ইবন মুয়াজকে ডেকে পাঠানো হল। সাদ আহত অবস্থায় রফায়দার তত্ত্বাবধানে ছিলেন। আউস গোত্রের লোকেরা তাকে একটি গাধার পিঠে চড়িয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে নিয়ে এল। নিয়ে আসার সময় তাকে তারা বলল, “আল্লাহর রাসূল আপনার উপর বিচারের ভার দিয়েছেন, বনি কুরায়জা এতদিন আমাদের যে উপকার করেছে আপনি সে উপকারের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত দেবেন এটা আশা করি।” কিন্তু সাদ ছিলেন দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তি এবং অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠ। তিনি ইহুদীদের স্বভাবের কথা জানতেন, তাদের বিশ্বাস ভঙ্গের কথা জানতেন এবং অতীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহুদীদের বিভিন্ন গোত্রের প্রতি যে করুণা দেখিয়েছেন তাও তিনি জানতেন।
তা ছাড়া তিনি এখন মৃত্যুপথযাত্রী, সুতরাং তিনি ভাবলেন, তিনি কারও পক্ষ অবলম্বন করে সিদ্ধান্ত দেবেন না। কারও প্রতি করুণাও প্রকাশ করবেন না। বিচার যত নিষ্ঠুরই হোক, নিরপেক্ষভাবে সেই বিচার তিনি করবেন। তিনি এখন আল্লাহর পথযাত্রী। সুতরাং তাঁর সিদ্ধান্তে কেউ অসন্তুষ্ট হলে তার যায় আসে না। সাদ যখন রাসূলের সম্মুখে এলেন তখন রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমবেত আনসার ও মুহাজিরগণকে বললেন, “তোমরা উঠে দাঁড়াও এবং তোমাদের সর্দারকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এস। পথের দুপাশে সারিবদ্ধভাবে তাকে স্বাগত জানাও।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদেশ পালিত হল। তখন তিনি সাদকে বললেন, “সাদ, একটি ফয়সালা করে দাও। বনি কুরায়জার প্রতি কি ধরনের আচরণ করতে হবে তার একটি সিদ্ধান্তের ভার তোমার উপর দেওয়া হল।” সাদ বিনীত কণ্ঠে বললেন, “হুকুম দেয়ার অধিকার তো একমাত্র আল্লাহ্ এবং রাসূলের।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আজ ফয়সালার অধিকার আল্লাহ্ তা’আলা তোমাকে দিয়েছেন। সাদ তখন সকলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা আমার বিচার মেনে নেবে না?”
তারা সকলেই একবাক্যে স্বীকৃতি জানালো। সাদ তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দিকে দৃষ্টিপাত করে প্রশ্ন করলেন, “এখানে যিনি বসে আছেন এই স্বীকৃতি কি তাঁরও?” এই প্রশ্নের উত্তর রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিলেন, “অবশ্যই এটা আমারও স্বীকৃতি।” তখন সাদ বনি কুরায়জার দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন, “তোমরা কি আমার সিদ্ধান্তের উপর রাযী থাকবে?” বনি কুরায়জার লোকজন একবাক্যে সম্মতি জ্ঞাপন করল। সাদ তখন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন, “ইহুদী পুরুষদিগকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হল, তাদের নারী ও শিশুদের বন্দী করা হবে এবং তাদের ধনসম্পত্তি বিশ্বাসীদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।” সাদের বিচার শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি যথার্থই সুবিচার করেছ এবং তোমার এ বিচারে আল্লাহর সমর্থন আছে। সাদের এই সিদ্ধান্তটি ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ তৌরাতের আইন অনুসারে করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, যখন তোমার প্রভু তোমাদিগকে বিজয় দিলেন এবং তাদেরকে তোমাদের নিকট সমর্পণ করলেন তখন তোমরা পরাজিত গোষ্ঠীর প্রত্যেক পুরুষের শিরশ্ছেদ করো এবং তাদের রমণী, শিশু এবং গৃহপালিত পশু, যা কিছু তাদের শহরের মধ্যে আছে এবং তাদের সম্পদ সব কিছু তোমরা গ্রহণ কর। (ডিউতা বোনোমী ২০ : ১২)
বনি কুরায়জার ধ্বংসের পর মদীনায় ইহুদীদের গোত্রগত আর প্রতাপ রইলো না। বস্তুত ইহুদীরা মদীনা থেকে চিরকালের জন্য উৎখাত হল বলা যেতে পারে। কিন্তু মদীনার বাইরেও ইহুদী ছিল এবং তারা প্রবলও ছিল। তারাও শেষ পর্যন্ত মুসলমান শক্তির কাছে পর্যুদস্ত হয় এবং তারা তাদের বসতি স্থান ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে যায় । মদীনা থেকে দু শ’ মাইল দূরে খায়বর ছিল একটি কৃষিপ্রধান অঞ্চল । এ অঞ্চলটি ছিল ইহুদীদের প্রধান কেন্দ্র। ইহুদীরা এখানে অনেকগুলো দুর্ভেদ্য দুর্গ নির্মাণ করেছিল । বনি নাজিরের সর্দারগণ মদীনা থেকে বহিষ্কৃত হয়ে খায়বরের ইহুদীদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এরা খায়বরে এসে বিভিন্ন আরব গোত্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদেরকে উত্তেজিত করেছিল, খায়বর থেকে সমুদ্র উপকূলের মধ্যবর্তী স্থানে গাতফান বলে একটি শক্তিশালী আরব গোত্র ছিল ।
ইহুদীদের প্রধান ছিল আবূ রাফে সালাম। সে চেষ্টা করতে লাগলো ইসলামের বিরুদ্ধে একটি বিরাট বাহিনী গড়ে তুলতে। এই উদ্দেশ্যে সে গাতফান এবং পার্শ্ববর্তী সকল গোত্রকেই ইসলামের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলল। সে একটি বিরাট বাহিনী গঠন করে মদীনা আক্রমণের জন্য উদ্যত হল। এ খবর পাবার পর আবদুল্লাহ ইব্ন উতাইক নামক জনৈক আনসার গোপনে কৌশলে রাফে সালামের দুর্গের মধ্যে প্রবেশ করে তাকে নিদ্রিত অবস্থায় হত্যা করে মদীনায় ফিরে আসে। রাফে সালামের হত্যার পর উসাইর ইবন জেবার ইহুদীদের প্রধান নিযুক্ত হল। সে বনি নাজিরদের সম্বোধন করে বলল, “আমার পূর্বপুরুষগণ মুহাম্মদের বিরুদ্ধে ভ্রান্তপথ অবলম্বন করেছিল। আমার মতে আমাদের মদীনা আক্রমণ করা কর্তব্য এবং আমি তাই করতে ইচ্ছা করি।” এ সংবাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শ্রুতিগোচর হলে তিনি আবদুল্লাহ ইব্ন রাওয়াহাকে খায়বরে গিয়ে ইহুদীদের পরিকল্পনা গোপনে জেনে আসতে নির্দেশ দেন।
রাওয়াহা গোপনে সংবাদ পেলেন যে ইহুদীদের বাহিনী গঠনের কথা সত্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমেই চেষ্টা করলেন ইহুদীদের সঙ্গে একটি সন্ধিতে আবদ্ধ হতে । তিনি রাওয়াহাকে সন্ধির উদ্দেশ্যে ইহুদীদের কাছে প্রেরণ করলেন। কিন্তু ইহুদীরা সন্ধিতে স্বীকৃত হল না। আবদুল্লাহ ইব্ন উবাই খায়বরের ইহুদীদের কাছে সংবাদ পাঠাল যে, মুসলমানদের নিয়ে ইহুদীদের ভয়ের কোন কারণ নেই, তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য। তাদের কাছে হাতিয়ার পর্যন্ত নেই।” এ খবর পেয়ে ইহুদীরা কেনানা ও আওদা নামক তাদের দুজন প্রতিনিধিকে গাতফান গোত্রের কাছে এই বলে খবর পাঠাপ যে তারা যেন একযোগে মদীনা আক্রমণ করে। পুরস্কারস্বরূপ বনি নাজিরের একটি খেজুর উদ্যানের উৎপন্ন খেজুরের অর্ধেক তাদের দেওয়া হবে। বনি ফাজারা গোত্রের লোকেরা গাতফান গোত্রের লোকদের বন্ধু ছিল। কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাদের কাছে রাসুপ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধ থেকে বিরত থাকবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তারা এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে।
খায়বরের ইহুদীদের শক্তি ছিল প্রচণ্ড। তাদের অর্থ ছিল, জীবন যাপনের সকল একার উপকরণ ছিল। মারণাস্ত্র ছিল প্রচুর এবং সর্বোপরি তারা তাদের সেনাবাহিনীকে প্রতিদিনই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত রাখত। সুতরাং তাদের ধারণা ছিল যে, মুসলমানগণ তাদের আক্রমণ করে কখনই জয়লাভ করতে পারবে না। কিন্তু তারা এটা ভেবে দেখেনি যে, সৈন্যাধ্যক্ষ হিসেবে রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উন্মাদ ছিলেন না, তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন এবং সতর্কতার সঙ্গে যুদ্ধে অগ্রসর হতেন। যখন ইহুদীগণ খবর পেল যে, যথার্থই মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে আক্রমণ করবেন বলে প্রস্তুত হয়েছেন তখন তারা গাতফান গোত্রের সাহায্য নিয়ে মুসলমান বাহিনীর মুকাবিলার জন্য প্রস্তুত হন। বনি নাজির গোত্রের সৈন্যসংখ্যা ছিল দশ হাজার। এর সঙ্গে মিলিত হল গাতফান গোত্রের চার হাজার সৈন্য। এই চৌদ্দ হাজার সৈন্যের আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাত্র ষোল শ’ সৈন্য নিয়ে এগিয়ে চললেন।

যুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার মুহূর্তে আউস গোত্রের একজন লোক, যার নাম ছিল আবূ হাবস, সে একটি সমস্যা নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে উপস্থিত ছিল। সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানাল যে একটি উট আছে বটে, কিন্তু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবার জন্য তার কোন ভাল জামা নেই, তাছাড়া গৃহের লোকদের জন্য কিছু অর্থ যে রেখে আসবে তাও তার নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তাকে একটি সুন্দর জামা দিলেন। যুদ্ধে রওয়ানা হওয়ার দুদিন পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লক্ষ্য করলেন যে, যে জামা তিনি আবূ হাবসকে দিয়েছিলেন সে জামা তার গায়ে নেই। তার পরিবর্তে একটি মলিন পুরনো জামা সে পরে গেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি তোমাকে যে জামা দিলাম তা কি করলে?” সে বিনীত এবং লজ্জিত কণ্ঠে বলল, “আমি আট দিরহামে সেটি বিক্রি করে দুই দিরহাম দিয়ে আমার নিজের জন্য খেজুর কিনেছি, দুই দিরহাম গৃহের খরচের জন্য দিয়ে এসেছি এবং চার দিরহাম দিয়ে একটি পুরনো জামা কিনেছি।” তার কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসে উঠলেন এবং বললেন, “হে হাবসের পিতা, তুমি সত্যিই খুব দরিদ্র। আমার আত্মার ওপর অধিকার যার সেই মহাপ্রভু আল্লাহর ইচ্ছায় যদি তুমি আরও কিছুদিন বেঁচে থাক তাহলে তুমি প্রচুর বিত্তের মালিক হবে। তখন অজস্র দিরহাম তোমার হাতের কাছে থাকবে এবং অগুণতি দাসদাসী তোমার সেবা করবে। তবে তা কিন্তু তোমার জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।”
কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সেনাবাহিনীকে থামতে বললেন। তিনি ইব্ন আল আকোয়া নামক আসলাম গোত্রের একটি লোককে কাছে ডাকলেন। লোকটির সুরেলা কণ্ঠস্বর ছিল বলে তিনি জানতেন। তিনি তাকে বললেন, “তুমি তোমার উট থেকে নামো এবং আমাদেরকে একটি গান গেয়ে শোনাও। বেদুঈনরা যখন উটে চড়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায় তখন তারা যেসব গান গায় তারই একটি তুমি আমাদের শোনাও।” ইব্ন আল আকোয়া গান ধরলেন : ‘হে আল্লাহ্! তুমি ছাড়া আর কেউ আমাদের পথ নির্দেশনা দেয়নি, কেউ আমাদের সাহায্য করেনি এবং কেউ তোমার জন্য প্রার্থনা করেনি।” এ গানটি কিন্তু উটের গান ছিল না। এ গানটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে শিখিয়েছিলেন খন্দকের যুদ্ধের সময়।
এরপর তাঁরা আবার চলতে আরম্ভ করলেন। দুদিনের পথ অতিক্রম করে যখন তারা খায়বরের প্রায় কাছে এসে পৌঁছলেন যখন তারা খায়বর এবং গাতফান গোত্রের এলাকার বাইরে এবং সংগুপ্ত স্থানে অবস্থান নিলেন, তখন রাত্রি ছিল এবং অসম্ভব অন্ধকার ছিল। নতুন চাঁদ সবেমাত্র ডুবেছে। তাদের গমন ছিল অত্যন্ত শান্ত এবং নিঃশব্দ। শত্রুপক্ষের কেউ তাদের আগমনে সাড়া পায়নি এবং কোন পাখিও ডেকে উঠে শত্রুপক্ষকে সজাগ করেনি। মুসলমানগণ কোনরূপ শব্দ না করে ফজরের নামায আদায় করলেন। ক্রমশ সূর্য উঠল এবং খায়বরের দুর্গ প্রাকারগুলো তাদের চোখে পড়লো। সে সময় একদল কৃষক কোদাল-কাস্তে এবং ঝুড়ি নিয়ে মাঠে কাজ করতে আসছিল। তারা মুসলমান সেনাবাহিনী দেখে ভয়ে ভীত হয়ে চিৎকার করতে করতে পালিয়ে গেল “মুহাম্মদ তাঁর দলবল নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।” তাদের চিৎকার শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে উঠলেন ‘আল্লাহু আকবর। এরপর তিনি উচ্চস্বরে বললেন: “খারিবত খায়বর অর্থাৎ খায়বর ধ্বংস হয়েছে।”
খায়বরে ইহুদীদের দুর্ভেদ্য অনেকগুলো দুর্গ ছিল, আগেই বলেছি। এই দুর্গগুলো জয় করতে মুসলমানদের যুদ্ধ করতে হয়েছিল। তাদের শেষ দুটি দুর্গ ‘ওয়াতিহ’ এবং ‘সুলালিন’ যখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবরোধ করলেন তখন ইহুদীরা নিশ্চিতভাবে বুঝলো যে, মৃত্যু ছাড়া তাদের আর কোন গতি নেই। তারা তখন তাঁর কাছে প্রাণভিক্ষা চাইল এবং খায়বর থেকে তারা চলে যাবে একথাও বলল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের প্রস্তাব মেনে নিলেন এবং প্রাণভিক্ষা দিলেন। ইতিমধ্যে রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহুদীদের আশ্শাক্ক, আন্নাতহা এবং আল কুতায়বার ভূমিসহ সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ দখল করেছিলেন। ফাদাক অঞ্চলের লোকেরা খায়বরবাসীদের অবস্থার কথা শুনে কোনরূপ যুদ্ধ ছাড়াই তাদের জমিজমা এবং ধন-সম্পদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাতে অর্পণ করার প্রস্তাব দিল এবং প্রাণভিক্ষা চেয়ে ফাদাক ত্যাগ করবে বলে স্বীকৃত হল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের অনুরোধ গ্রহণ করলেন। পরে খায়বরবাসীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে নতুন একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। যেহেতু তারা কৃষিকর্মে অত্যন্ত দক্ষ ছিল তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের খায়বর থেকে বিতাড়িত করলেন না। বরং অর্ধেক বর্গাভাগের ভিত্তিতে সেখানকার জমিজমা চাষের কাজে তাদেরকে নিয়োজিত করলেন। অবশ্য এর সঙ্গে আরেকটি শর্তও ছিল যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইচ্ছা করলে যে কোন সময় তাদেরকে উচ্ছেদ করতে পারবেন। এভাবেই খায়বর বিজয় সম্পন্ন হল।
খায়বর বিজয় সম্পর্কে কবি ইব্ন লুকাইম একটি কবিতা রচনা করেছেন। ইবন হিশাম তাঁর “সীরাতে”এই কবিতাটি উদ্ধৃত করেছেন। কবিতাটির বাংলা অনুবাদ হলো :
এক দুরন্ত দুঃসাহসী সাদা বেশধারী সেনাদল পরিবেষ্টিত নবী কর্তৃক নাতা আক্রান্ত হল,
নাতাবাসী যখন ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লো
এবং আসলাম ও গিফার গোত্রদ্বয়ও তার মাঝে বিচ্ছিন্ন হলো তখন তারা নিশ্চিত হলো পরাজয় সম্পর্কে।
বনু আমর ইবন জুরআর লোকেরা প্রভাতকালেই দেখতে পেল,
আশশাক-এর অধিবাসী দিনের বেলাতেই ঘোর অন্ধকারে পতিত হয়েছে।
তার সমগ্র সমভূমি জুড়ে দৌড়ে গেছে ধ্বংস মৃত্যু।
প্রত্যূষে চিৎকারকারী মোরগগুলো ছাড়া কোন কিছুকেই তা অবশিষ্ট রাখেনি।
তারা প্রতিটি দুর্গকে অধিকার করেছে আবদ্ আসহাল
কিংবা বনু নাজ্জারের অশ্বারোহিগণ।
আর মুহাজির যারা শিরস্ত্রাণের ওপর দিয়ে তাদের কপালকে উন্মুক্ত করেছে যারা পালানোর কথা চিন্তাও করতে পারে না।
আমি জানতাম, মুহাম্মদ অবশ্যই জয়লাভ করবে এবং
যুগ যুগ ধরে সেখানে অবস্থান করবে।
সেই দিনের চিৎকারে হুঙ্কারে ইহুদীদের চোখ খুলে গেছে।
এভাবেই মদীনায় রাসূলের বিরুদ্ধে ইহুদীদের ষড়যন্ত্র চিরকালের জন্য অবসান হল। রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমরা লক্ষ্য করলাম যে তাঁর বিচারে শত্রুদের প্রতি কখনও কঠোর হয়েছেন, আবার অধিকাংশ সময়ই শত্রুদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে ক্ষমার মহিমা ছিল অগাধ, কিন্তু অন্যায় কর্মের জন্য দণ্ড বিধানও ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র পৃথিবীর কাছে যে আদর্শ উপস্থিত করেছেন তা হচ্ছে- ক্ষমা এবং ন্যায়ানুগ প্রতিকার বিধানের আদর্শ। প্রথমটি হচ্ছে ‘আখলাক’ এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে ‘কানুন’। এ উভয়ের সমন্বয়েই ইসলামের ন্যায় বিধান গড়ে উঠেছে। ধর্মের আদর্শ প্রতিষ্ঠা, সমাজের কল্যাণ ও রাষ্ট্রীয় শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ন্যায়ানুগ শাস্তির ব্যবস্থা করতেন. কিন্তু ক্ষমা ও অনুকম্পাই ছিল তাঁর জীবনের মৌলিক আদর্শ।
আরো জানতে ভিজিট করুন আমাদের ওয়েব সাইট রাহে সুন্নাত ব্লগ