মানব জাতির মুক্তি ও কামিয়াবী

মানব জাতির মুক্তি ও কামিয়াবী

ইবাদত ইসলাম প্রতিদিন ইহকাল-পরকাল কুরআন ও সুন্নাহ প্রবন্ধ

মানব জাতির মুক্তি ও কামিয়াবী সুরাতুল আসরের ৪ মূলনীতির আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক

সুরাতুল আসরে যেমনটি ইরশাদ হচ্ছে-

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ۝ وَالْعَصْرِ ۝ إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِىْ خُسْرٍ ۝ إِلَّا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ ۝ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ ۝

এই সুরাটি এমন অর্থপূর্ণ সুরা যার সম্পর্কে ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, মানুষ শুধু এ সুরাটিকেই গভীর মনোযোগ সহকারে পাঠ করলে এবং এর মর্ম বুঝে সে অনুযায়ী আমল করলে তাদের ইহকাল ও পরকাল সংশোধনের জন্য যথেষ্ট হতে পারে।

এ সুরায় আল্লাহ তা‘আলা যমানার কসম করে বলেছেন, মানবজাতি অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত এবং এই ক্ষতির কবল থেকে তারাই মুক্ত, যারা চারটি বিষয় নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে। ১. ঈমান গ্রহণ করা। ২. আমলে সালেহ তথা সৎকর্ম সম্পাদন করা। ৩. অপরকে সত্যের উপদেশ দান করা। ৪. অন্যদের সবরের উপদেশ দান করা।

দ্বীন ও দুনিয়ার ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার এবং মহা উপকার লাভ করার চার বিষয় সংবলিত এ ব্যবস্থাপত্রের প্রথম দুটি বিষয় আত্মসংশোধন সম্পর্কিত এবং দ্বিতীয় দুটি বিষয় অপর মুসলমানদের হেদায়াত ও সংশোধন বিষয়ক। সারকথা হলো বর্ণিত সুরায় দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে-

১. সালাহ্ অর্থাৎ, নিজের সার্বিক মঙ্গলের পথ অবলম্বন করার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন।

২. ইসলাহ অর্থাৎ, অপরের সার্বিক সংশোধনের ব্যাপারে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার মাধ্যমে অন্যের আত্মশুদ্ধি সাধন।
সালাহ এর মাঝে আবার দুটি জিনিস রয়েছে- ১. ঈমান, ২. আমলে সালেহ। আর ইসলাহের মধ্যে রয়েছে আরো দুটি বিষয়- ১. তাওয়াসী বিল হক ২. তাওয়াসী বিস্সবর।

প্রথমত : সহীহ ঈমান ও আকাইদ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা

মুমিনের জীবনে ঈমান সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। ঈমানকে সুদৃঢ় ও পাকাপোক্ত করা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য জরুরী। কারণ, ঈমান ঠিক না করে সারা জীবন ইবাদত করলেও লাভ হবে না। ঈমানের মৌলিক ছয়টি বিষয়ের সঙ্গে ঈমানের ৭৭টি শাখার পূর্ণজ্ঞান এবং সহীহ আকীদা—বিশ্বাসে অটল—অবিচল থাকতে হবে। এভাবে নিজের যাহের ও বাতেনকে সংশোধন করে পরিপূর্ণ আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে হবে। যা মূলত ঈমানেরই অংশ বিশেষ। যাতে ফিতনা—ফাসাদের যুগে ঈমান রক্ষা করা সহজ হয়। হাদীস শরীফে আছে, (ফিতনার যামানায়) অনেক মানুষ সকালে মুমিন থাকবে, বিকেলে হয়ে যাবে কাফের। (নাউযুবিল্লাহ) -জামে তিরমিযী, হাদীস নং- ২১৯৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ১১৮

দ্বিতীয়ত : আমালে সালেহা অর্থাৎ, নেক আমল করা।

জাহের—বাতেনের আমলগুলো দুরস্ত করা অর্থাৎ, সকল কাজে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের অনুসরণ করা। আমলে সালেহ—এর মানদণ্ড হচ্ছে সুন্নাত। আমলে সালেহ শুধু মানুষের বাহ্যিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও কার্যকলাপের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। দেহ ও আত্মার সমষ্টির নাম মানুষ। ইসলাম যেহেতু পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান ও পরিপূর্ণ জীবনদর্শন, এজন্য উভয়বিধ বিষয়ে শরীয়তের আহকাম তথা বিধানাবলী রয়েছে। কুরআন ও হাদীসে মানুষের সংশোধন ও সফলতা বিষয়ের উপর সুনির্ধারিত বিধান রয়েছে। এ মর্মে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হচ্ছে—

وَذَرُوْا ظَاهِرَ الْإِثْمِ وَبَاطِنَهٗ

অর্থ : “তোমরা যাহেরী ও বাতেনী সর্বপ্রকার গুনাহ পরিত্যাগ কর।” —সুরা আনআম : ১২০

যাহেরকে দুরস্ত করার অর্থ— উযূ, নামায, রোযা, আযান, ইকামত ইত্যাদি ইবাদত বন্দেগী যেগুলো প্রকাশ্যভাবে করা হয় এবং করা জরুরী সে আমলগুলো সুন্নাত মোতাবেক করা। দিলের মধ্যে খাঁটিভাবে ইসলামের আকীদা পোষণ করা।

তাফসীরকারগণ বলেছেন, জাহের বা প্রকাশ্য গুনাহ হলো যা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারা সংঘঠিত হয় আর গোপন গুনাহ হলো যা অন্তর দ্বারা করা হয়। যেমন— বাতিল আক্বীদা পোষণ করা বা হালাল বস্তুকে হারাম মনে করা।

বিখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন মুজাহিদ রহ. বলেছেন— মানুষ তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারা যে পাপকার্য করে তা প্রকাশ্য গুনাহ। আর যে মন্দ কাজের ইচ্ছা করে তথা মনে মনে মন্দ কাজের কথা ভাবে তা গোপন গুনাহ।

সুতরাং সগীরা বা কবীরা সকল প্রকার পাপকার্য আল্লাহ তা‘আলার হক্বের ব্যাপারে হোক অথবা বান্দার হক্বের ব্যাপারে হোক যাবতীয় পাপাচার পরিহার করা অবশ্য কর্তব্য। অথবা জাহেরী পাপের অর্থ হলোÑ কুফর আর গোপন পাপ হলো মোনাফেকী। জাহেরী বা প্রকাশ্য গুনাহ হলো—শরীয়তের বিধান প্রকাশ্যে অমান্য করা যেমন— নামায, রোযা না করা। আর গোপন পাপ হলো যত্ন সহকারে নামায আদায় না করা বা রমযানে পানাহার পরিহার করেও পাপাচরে লিপ্ত থাকা বা হারাম রিযিক গ্রহণ করা আর গোপন পাপ হলো যা অন্তরের সাথে সম্পর্কিত যেমন— রিয়া তথা লোক দেখানোর জন্য সৎকাজ করা। হিংসা—বিদ্বেষ, অনর্থক গোস্বা, অহংকার, লোভ—লালসা, যশখ্যাতি অর্জনের স্পৃহা ইত্যাদি।

আল্লামা ছানাউল্লাহ পানিপথি রহ. এ আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন, এর অর্থ হলো প্রকাশ্য ও গোপন যাবতীয় পাপকার্য পরিত্যাগ কর।

বর্তমানে অধিকাংশ মুসলমানদের ঈমান—আকীদাগত মারাত্মক ফিৎনা মহামারির আকার ধারণ করেছে। উদাহারণ স্বরূপ হাদীস শরীফে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

لَا عَدْوٰى وَلَا طِيَرَةَ وَلَا هَامَةَ وَلَا صَفَرَ

অর্থ : “রোগে সংক্রমণ নেই, শুভ—অশুভ আলামত বলে কিছুই নেই। পেঁচায় অশুভ আলামত নেই এবং সফর মাসে অকল্যাণ নেই।” —সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৫৭৫৭

যেমন— বুখারী শরীফের অনেক হাদীসে আছে যে, রোগে সংক্রমণ নেই। কোনো রোগই ছোঁয়াচে নয়। কিন্তু বর্তমানে কভিড—১৯ করোনা ভাইরাস বিশ্বব্যাপী মহামারীর আকার ধারণ করাতে চিকিৎসা বিজ্ঞানী, অণুজীব বিজ্ঞানীগণ সংক্রমণের বিষয়টি মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার—প্রসার করে মুসলিম—অমুসলিম সমাজের মধ্যে করোনা ভাইরাস রোগ সংক্রমিত হয় বলে অপপ্রচার করে যাচ্ছে। যা ইসলাম ও ঈমান আক্বিদা পরিপন্থী বাতিল আক্বীদা। তবে এক্ষেত্রে ঈমান—আকীদা ঠিক রেখে শরীয়তের গণ্ডির মধ্যে থেকে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরী। অনুরূপ হালালকে হারাম মনে করাও বাতিল আক্বীদা।

এ ধরণের প্রচার—প্রসারের অন্তরালে ইসলামের দুশমনদের গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একটি ইস্যুতে লক্ষ—কোটি ঈমানদারকে ঈমান নষ্ট করার এক দুরভিসন্ধি।

প্রতিটি মুমিনের দুনিয়া—আখেরাতের সফলতা নির্ভর করে করণীয় দুই বিষয়ের উপর—

১. সহীহ ঈমান—আকীদা। ২. সুন্নাতের অনুসরণ।

ঈমান—আকীদা পরিশুদ্ধ হবে তো আখেরাত বনবে। আর সুন্নাতের অনুসরণ হবে তো দুনিয়াতে সফলতা আসবে। অতএব উভয়টি যদি ঠিক হয়ে যায়, তাহলে তার দুনিয়া—আখেরাত উভয় জগতেই সফলতা আসবে।

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন—

مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّنْ ذَکَرٍ اَوْ اُنْثٰی وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْیِیَنَّهٗ حَیٰوۃً طَیِّبَۃً ۚ وَلَنَجْزِیَنَّهُمْ اَجْرَهُمْ بِاَحْسَنِ مَا کَانُوْا یَعْمَلُوْنَ

অর্থ : “যারা নেক কাজ করবে, পুরুষই হোক আর স্ত্রী হোক; যদি তারা ঈমানদার হয় তবে আমি তাদেরকে শান্তিময় জীবন দান করি।” —সুরা নাহল : ৯৭

কুরআন—সুন্নাহর মধ্যে মানুষের বাহ্যিক সূরত শেকেল ও মু‘আমালা—মু‘আশারা এবং বাতেনী আক্বীদা ও আখলাক সবকিছুর সংশোধনের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা রয়েছে। উম্মতের মধ্যে সাহাবা রাযি. ও তাবেঈ রহ. গণ থেকে বর্তমান যুগের বিশিষ্ট নেককার ব্যক্তিবর্গ পর্যন্ত যে যতটুকু পূর্ণতা লাভ করেছেন, তা শুধুমাত্র কুরআন—সুন্নাহ বর্ণিত আমল পরিপূর্ণ রূপে মানার দ্বারাই হয়েছে। তারা যেভাবে নামায রোযা, হজ, যাকাতের অনুগামী ছিলেন। তেমনিভাবে বাতেনী আমলে অর্থাৎ, সিদ্ক, ইখলাস, তাওহীদ, তাওয়াযু, সবর, শোকর, তাওয়াক্কুল, যুহুদ ইত্যাদির মধ্যেও পূর্ণতা অর্জন করেছিলেন। তারা যেভাবে মিথ্যা, গীবত, ধেঁাকা, চুরি, ব্যভিচারী, নির্লজ্জতা ইত্যাদি গুনাহকে ভয় করতেন এবং তা থেকে বেঁচে থাকতেন ঠিক একইভাবে অহংকার, রিয়া, হিংসা, পদলিপ্সা, ধনলিপ্সা, লোভ, কার্পণ্য ইত্যাদি বাতেনী গুনাহসমূহকে হারাম জানতেন এবং তা থেকে বাঁচার প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে দ্বীন ও দ্বীনী ইলম সম্পর্কে একটি সীমাবদ্ধ চিন্তা, ফিকির এবং দ্বীনের সকল বিষয়ের মেহনতের মধ্যে এক বিরাট সংকীর্ণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে ইলমে তাসাউফের চর্চা যার সম্পর্ক মানুষের বাতেনী আমল সংশোধনের সঙ্গে তা এমনই পরিত্যক্ত হয়েছে যে, সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা ইল্লা—মাশাআল্লাহ আলেমগণের অধিকসংখ্যক এর থেকে সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছে। শুধু বাহ্যিক আমল সম্পাদনের মতো দ্বীনকে সীমাবদ্ধ মনে করা হচ্ছে। শুধু পরিভাষাগত শব্দ যেমনÑ সিদ্ক, ইখলাস, তাওহীদ, তাওয়াক্কুল, সবর, শোকর, কানা‘আত, যুহুদ, তাকওয়া ইত্যাদি শুধু মুখে মুখেই উচ্চারিত করছে পক্ষান্তরে অহংকার, হিংসা, ধনলিপ্সা, পদলিপ্সা, রিয়া ইত্যাদি হারাম ও ধ্বংসাত্মক ব্যাধিসমূহ থেকে মুক্তি লাভের চিন্তাও অন্তর থেকে মিটে গেছে। অথচ আত্মশুদ্ধির মূল কথাই হলো, শরীয়তের জাহের বাতেনের পূর্ণাঙ্গ বিধিবিধানের উপর আমল করা।

ইতিহাস সাক্ষী যে, দুনিয়াতে শুধু ওই সমস্ত মনীষীগণের তা‘লীম, তাবলীগ, ইসলাহ ও তারবিয়্যতের রীতি ও ধারা স্থায়ীত্ব লাভ করেছে, যাদের মধ্যে উভয়টির সমন্বয় ছিল। অন্যথায় বিভিন্ন যুগের অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিগণের অনেক ধরনের গবেষণা ও চিন্তাধারা পেশ করেছেন, কিন্তু বর্তমানে তার নাম নিশানাও চোখে পড়ে না। মোদ্দাকথা, আমলে সালেহ বলতে জাহের—বাতেন উভয়কে দুরস্ত করাকেই বুঝায়।

উক্ত সুরায় প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্বে প্রথমত নিজের ঈমান—আমল দুরস্ত করা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, একই সাথে সাধ্যনুযায়ী অন্য মুসলমানকে ইলম ও আমলের দিকে আহ্বান করাও ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ।

শুধু নিজের আমল ঠিক করাই নাজাতের জন্য যথেষ্ট নয়। বিশেষত নিজের পরিবার—পরিজন, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের বদ আমলের ব্যাপারে গাফেল হওয়ার অনিবার্য ফল হলো, নিজের নাজাতের পথ বন্ধ করা। চাই যত আমলকারী হোক না কেন। কুরআন শরীফের আয়াতে কারীমায় প্রত্যেক মুসলমানের উপর যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী আমর বিল মারুফ নাহী আনিল মুনকার ফরয করা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা যেমনিভাবে ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেকে ঈমান ও আমলে সালেহ অর্জন করার হুকুম দিয়েছেন, তেমনিভাবে অন্যকে সৎ বানানো বা অন্যের ইসলাহের জন্য প্রচেষ্টা চালানোরও ফিকির করার নির্দেশ দিয়েছেন।

হাদীসের কিতাব জামে তিরমিযী, সুনানে ইবনে মাযাহসহ অন্যান্য হাদীসের কিতাবের বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনÑ ‘ওই সত্তার কসম! যার হাতে আমার প্রাণ; তোমরা হয় আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার করতে থাকবে, না হয় অচিরেই গুনাহগারদের সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের উপর আযাব পাঠিয়ে দিবেন। তখন তোমরা দু‘আ করবে কিন্তু তোমাদের দু‘আ কবুল হবে না। —জামে তিরমিযী, হাদীস নং—২১৬৯

দাওয়াতের কাজ নিকট আত্মীয়দের থেকে শুরু করা

কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন—

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا قُوْۤا اَنْفُسَكُمْ وَاَهْلِیْكُمْ نَارًا

যার অর্থ হচ্ছে, “হে ঈমানদারগণ! নিজকে এবং নিজের পরিবারবর্গকে দোযখ হতে বাঁচাও।” —সুরা তাহরীম : ৬

উক্ত আয়াতের তাফসীরে হযরত আলী রাযি. বলেন, পরিবারবর্গকে দোযখ হতে বাঁচাও। এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, নিজের স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদেরকে ধর্ম বিষয়ক শিক্ষা দেয়া ফরয। অন্যথায় পরিণাম ফল দোযখ। Ñতারগীব
যদি পরিবারের সকল লোক একই পথের অনুসারী না হয়, তাহলে একার পক্ষে তাকে দ্বীনের উপর অটল অবিচল রাখা কঠিন। পুরো পরিবারে যদি একজন নামায রোযার পাবন্দ হয় তখন পাকা নামাযী হলেও তাকে অনেক প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়।

হযরত ফুকাহায়ে কিরাম বলেছেন, এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেক ব্যক্তির উপর তার স্ত্রী, সন্তানদেরকে হালাল—হারামসহ শরীয়তের যাবতীয় বিধিবিধান শিক্ষা দেয়া এবং সে অনুযায়ী তাদেরকে আমল করানোর চেষ্টা করা ফরয। অপর এক হাদীসে এসেছেÑ কিয়ামতের দিন সবচেয়ে বেশি আযাব তাদের হবে, যাদের পরিবার—পরিজন দ্বীনের বিষয়ে জাহেল ও গাফেল ছিল। —রুহুল মাআনী

অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন—

وَاَنْذِرْ عَشِیْرَتَكَ الْاَقْرَبِیْنَ

অর্থ : “আপনি আপনার নিকট আত্মীয়দেরকে ভীতি প্রদর্শন করুন।” —সুরা শু‘আরা : ২১৪

এই আয়াতের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে তাঁর বংশের লোকদেরকে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছিলেন।

তৃতীয়ত : তাওয়াসী বিল হক।

চতুর্থত : তাওয়াসী বিসসবর।

অর্থাৎ, উম্মতকে সত্যের পথে আহবান করা এবং তাদেরকে কষ্টক্লেশ ও বিপদ আপদের সময় ধৈর্যের উপদেশ দান করা এবং এভাবে তাদের ইসলাহ করা। তথা আত্মিক ও মানসিক ভাবে তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে গড়ে তোলার চেষ্টা চালানো। আর এ দুটির সম্পর্ক হচ্ছে অন্যের সঙ্গে। ইসলাহ বলা হয় অন্যকে নেক ও ভালো বানানোর চেষ্টা করাকে। অপরকে ঈমান ও আমলে সালেহের জন্য উৎসাহিত করা এবং তার জন্য চেষ্টা করা। সালাহ এবং ইসলাহ হলো দুটি বুনিয়াদী কাজ। যা প্রত্যেকের জন্য সাধ্যানুযায়ী করা জরুরী। যারা কাজ দুটি করেন এবং—এর জন্য ফিকির রাখেন, মেহনত করেন, তারাই কামিয়াব। তারাই ক্ষতি ও লোকসানমুক্ত।

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন—

وَلْتَكُنْ مِّنْكُمْ اُمَّةٌ يَّدْعُوْنَ اِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَاُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ

অর্থ : “তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা বাঞ্ছনীয় যারা (অন্যান্য লোকদেরকে) মঙ্গল ও কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে। নেক কাজ করার জন্য বলবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে। এরাই পুরোপুরি সফল হবে।” —আলে ইমরান : ১০৪

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন—

مُرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَانْهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ

অর্থ : “ভালো কাজের আদেশ কর এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করতে থাক।” -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং— ৪০০৪

হযরতওয়ালা মুহিউস সুন্নাহ শাহ আবরারুল হক রহ. বলেন— “যেভাবে আমর বিল মারূফ বা সৎকাজের আদেশ—এর দ্বারা বিভিন্ন পন্থায় কাজ হচ্ছে অনুরূপভাবে নাহী আনিল মুনকার বা অসৎ কাজে বাধা প্রদানের ব্যাপারেও গুরুত্ব প্রদান করা উচিত। উভয়টি ফরযে কেফায়া।” ইদানিং অন্যায় কাজে বাধা না দেয়ার কারণে অন্যায় দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে। আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার তথা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ এ উম্মতের জিম্মাদারী ও দায়িত্ব। ভালো কাজের প্রসার যেমন ভাবে ফরযে কিফায়াহ। তেমনিভাবে মন্দ কাজের সংশোধন করাও ফরযে কিফায়াহ। ভালো কাজের উপর তো মাশাআল্লাহ বেশ মেহনত হচ্ছে কিন্তু মন্দ কাজে বাধা প্রদানকারী জামা‘আত খুব কমই নযরে পড়ে। আজকাল এ কাজ খুব কমই হচ্ছে। এটার জন্য স্বতন্ত্র জামা‘আত থাকা অপরিহার্য।

আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়াকে ঈমান ও আমলে সালেহ—এর উপর মওকূফ করেছেন, তেমনি হক ও সবরের ব্যাপারে পারস্পরিক দাওয়াত, ফরমায়েশ ও তাগাদা প্রদানের উপর ক্ষতি থেকে বাঁচাকে মওকূফ করেছেন।

وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ

এর অর্থ : সহীহ ঈমান ও আমালে সালেহের সমষ্টি। আর সবর হচ্ছে তিনটি বিষয়ের সমষ্টি। ইবাদতে অটল থাকা, যাবতীয় গুনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকা এবং বিপদে ধৈর্য ধারণ করা।

উক্ত আয়াতে দুটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। ১. তাওয়াসি বিল হক। ২. তাওয়াসি বিস্সবর। তাওয়াসি বিল হক বলা হয় একে অন্যকে হকের অসিয়্যত করা। হকের তাবলীগ করা। দ্বিতীয় বিষয় হলো তাওয়াসি বিসসবর। এর দ্বারা উদ্দেশ্য আমল। আর ‘সবর’—এর সংজ্ঞা নফস বা প্রবৃত্তিকে তার কাক্সিক্ষত বিষয় ও কর্ম হতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা।

ইবাদতে সবর অর্থাৎ, ইস্তেকামাত, গুনাহ থেকে হিম্মত করে বেঁচে থাকা অর্থাৎ, সংযম করা, বিপদে ধৈর্য ধারণ করা।
আজ উম্মত সালাহ ও ইসলাহের দুটি বুনিয়াদী কাজ ছেড়ে দিয়ে নিজেদের দ্বীন মাযহাবকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা শাহ আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেন, আজ মুসলমানদের আমল—আখলাক খারাপ হয়ে যাওয়ার দরূন যাহেরী, বাতেনী তথা প্রকাশ্য—অপ্রকাশ্য অধ:পতন চরমে পেঁৗছেছে এবং বিভিন্ন রকম বালা—মসীবতে পরিবেষ্টিত হয়ে একের পর এক ফিতনা—ফাসাদ ঘিরে ধরেছে। যদি এর প্রতিকারের আশু ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, তাহলে প্রবল আশঙ্কা করা হচ্ছে, (আল্লাহ না করুন) মুসলিম জাতি সত্তাই হুমকির সম্মুখীন হবে। এ মুহূর্তে এ সংকট নিরসনে সকলেরই সজাগ হওয়া সময়ের বড় দাবি। মুসলিম জাতির এ যুগসন্ধিক্ষণে দ্বীন ও দুনিয়ার ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সফলতা এবং সংকট থেকে উত্তরণের জন্য উক্ত সুরার চারটি বিষয় সংবলিত এ খোদায়ী ব্যবস্থাপত্রের আলোকেই আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। উম্মাহর প্রত্যেক মুমিনই যেহেতু আল্লাহ তা‘আলার বান্দা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামÑএর উম্মত তাই তাদের যিম্মায় চারটি কাজ যথাযথভাবে আঞ্জাম দেয়া ফরয। একেই কুরআনে কারীমে আমর বিল মারূফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

আল্লাহর আইন শাশ্বত ও চিরন্তন

মহানবী জগতের আদর্শ মহামানব। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *