
শিক্ষাদীক্ষা :
হারদুয়ী শহরে স্বীয় পিতা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইসলামিয়া মাদরাসায় তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন এবং মাত্র ৮ বছর বয়সে পূর্ণ কুরআন শরীফ হিফয সম্পন্ন করেন। ১৩৪৯ হিজরীতে উচ্চ শিক্ষার্থে তিনি ভারতের প্রসিদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র সাহারানপুর মাজাহিরুল উলূম মাদরাসায় ভর্তি হন এবং ১৩৫৬ হিজরী সনে কৃতিত্বের সাথে ১ম স্থান অধিকার করে দাওরায়ে হাদীস তথা সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভ করেন। [উল্লেখ্য, হযরতজী ইউসুফ রহ. ও হযরতজী ইন‘আমুল হাসান রহ. তাঁর দাওরায়ে হাদীসের সাথী ছিলেন।] ঠিক একই নিয়মে ১৩৫৮ হিজরী সনে কৃতিত্বের সাথে ১ম স্থান অধিকার করে “তাকমীলে ফুনূন” তথা উচ্চতর শাস্ত্রীয় গবেষণাও সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবন :
শিক্ষা সমাপ্ত করার পর শিক্ষকবৃন্দের ইচ্ছায় সাহারানপুর মাজাহিরুল উলূম মাদরাসায়ই তিনি শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এখানে কিছু দিন শিক্ষকতা করার পর স্বীয় শাইখ হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রহ.-এর নির্দেশে তিনি মাদরাসা জামিউল উলূমে চলে যান। সেখানকার কর্তৃপক্ষ তাঁর ইলমী গভীরতা ও অসাধারণ যোগ্যতায় মুগ্ধ হয়ে “শাইখুল হাদীস” হিসাবে পদোন্নতি দান করেন। এরপর হযরত থানভী রহ.-এর দ্বিতীয় বারের মাশওয়ারায় তিনি ফতেহপুর ইসলামিয়া মাদরাসায় চলে যান এবং সেখানে সুনামের সাথে শিক্ষকতা করতে থাকেন।
‘আশরাফুল মাদারিস’ এর প্রতিষ্ঠা:
অতঃপর যুগের চাহিদা পুরণে দ্বীনের চতুর্মূখী কার্যক্রম চালু করার লক্ষ্যে ১৩৬২ হিজরীতে শাইখের হুকুমে নিজ এলাকায় চলে যান এবং জাতির আকাঙ্খা পুরনে যুগান্তকারী মাইলফলক হিসাবে হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ.-এর দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে মাদরাসায়ে আশরাফুল মাদারিস প্রতিষ্ঠা করেন। এবং অক্লান্ত পরিশ্রম, সীমাহীন ত্যাগ তিতিক্ষা এবং আত্ম উৎসর্গের মাধ্যমে সেটাকে এমন সুবিন্যস্ত করে ঢেলে সাজান; যা পরবর্তীতে অন্যান্য সকল মাদরাসার জন্য আদর্শ হিসাবে পরিগণিত হয়। মাদরাসায়ে আশরাফুল মাদারিস নিছক একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম নয় বরং শিক্ষা-দীক্ষা, আত্মশুদ্ধি, দাওয়াত ও তাবলীগসহ দীনের যাবতীয় খেদমত অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক পদ্ধতিতে আঞ্জাম দেয়ার এক বৃহৎ একটি প্রতিষ্ঠান। যার ফুয়ূয ও বারাকাত শুধু এশিয়ায় নয় বরং সারা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের উলামায়ে কেরাম তাঁর ফয়েয পেয়ে ধন্য হয়েছে।
আধ্যাত্মিক জীবন :
ছাত্র জীবন থেকেই তিনি হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রহ.-এর সাথে ইসলাহী সম্পর্ক গড়ে তুলেন। মাজাহিরুল উলূম মাদরাসায় অধ্যয়নকালে তিনি হযরত থানভী রহ. এর হাতে আত্মশুদ্ধির বাইআত গ্রহণ করেন এবং প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর দরবারে উপস্থিত হয়ে আধ্যাত্মিক সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে থাকেন। অধ্যয়ন থেকে ফারেগ হওয়ার পর ফতেহপুর মাদরাসায় অধ্যাপনা কালে মাত্র ২১ বছর বয়সে হযরত থানভী রহ. কর্তৃক খেলাফত লাভ করেন। চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা এমনকি মন-মানসিকতা আধ্যাত্মিক সাধনা, নিয়মানুবর্তীতা ইত্যাদিসহ সকল গুণাবলীর বিচারে হযরত থানভী রহ.-এর প্রতিচ্ছবি তাঁর ব্যক্তিত্বে ফুটে উঠায় সমাজের লোকেরা তাঁকে দ্বিতীয় থানভী বলে আখ্যায়িত করে। থানভী চিন্তা চেতনায় উদ্ভাসিত এ মহান ব্যক্তিত্ব আধ্যাত্মিক সাধনায় এমন উৎকর্ষ সাধন করেন যে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, জাতির কান্ডারী অসংখ্য অগণিত উলামায়ে কেরাম তাঁর হাতে বাইআত গ্রহণ করেন এবং নিজেদের আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটান। ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকায় রয়েছে তাঁর লক্ষ লক্ষ ভক্ত-মুরীদ। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ পীর-মাশায়েখ এবং শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরামও তাঁরই স্নেহধন্য মুরীদ ও খলীফা। বাংলাদেশে তাঁর উত্তরসুরী হিসাবে রয়েছে বিশিষ্ট ২৮ জন খলীফা।
মজলিসে দাওয়াতুল হকের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন :
হযরত থানভী রহ. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মজলিসে দাওয়াতুল হককে তার লক্ষ্যপানে পৌঁছাতে তিনি তাঁর পুরো জীবনটা ওয়াকফ করে দেন। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ, দ্বীনী শিক্ষার ব্যাপক প্রচার-প্রসার, মাদরাসা ছাত্র-শিক্ষকদের বিশেষ তারবিয়ত, ইসলাহী মাজালিস, খাঁটি মুসলমান তৈরীর জন্য দেশ-বিদেশে সফর, শর‘ঈ বিধান মুতাবিক মসজিদ পরিচালনা, বিনা পারিশ্রমিকে দ্বীনী খেদমত, দুঃস্থ মানবতার সেবা এবং অসহায় দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোসহ মজলিসে দাওয়াতুল হকের যাবতীয় কর্মসূচী বাস্তবায়নে আমৃত্যু কঠিন সাধনা চালিয়ে যান তিনি। ছুটে যান এশিয়া-আফ্রিকা ও ইউরোপ-আমেরিকার আনাচে-কানাচে। লক্ষ লক্ষ পথহারা মানুষের হৃদয়ে জ্বালান হেদায়াতের অগ্নিমশাল। প্রতিষ্ঠা করেন দেশ-বিদেশে শত শত দ্বীনী প্রতিষ্ঠান।
মনীষীদের উক্তি
* উপমহাদেশের মহান শিক্ষাবিদ আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. বলেন : ‘হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক সাহেব দা. বা. আযীমতের অধিকারী এক মহান শাইখ ও নির্ভীক দায়ী ইলাল্লাহ।’
* তাবলীগ জামা‘আতের বিশ্বআমীর হযরত ওয়ালার দরসের সাথী হযরত মাওলানা ইন‘আমূল হাসান হযরতজী রহ. বলেন: ‘হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক সাহেব হচ্ছেন এক অসাধারণ মুসলিহুল উলামা। উলামায়ে কেরামের সংশোধনের মত দূরহ কাজ কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব।’
* বিচারপতি আল্লামা তাকী উসমানী দা. বা. বলেন: ‘আখেরী যুগে হযরতের অস্তিত্ব উম্মতের জন্য বিশাল এক পুজিঁভান্ডার। আলহামদুলিল্লাহ তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা এবং হেদায়াতের ফুয়ূয ও বারাকাত সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে।’
মৃত্যু বা আখেরাতের সফর :
উপমহাদেরশের এ মহান ধর্মীয় সংস্কারক, সুন্নাতে নববীর উজ্জল নক্ষত্র, যুগশ্রেষ্ঠ ওলীয়ে কামেল, হাকীমূল উম্মত হযরত থানভী রহ.-এর সর্বশেষ খলীফা ১৭ মে ২০০৫ ঈসায়ী মঙ্গলবার সারা দিন কর্ম ব্যস্ত থেকে রাত আট ঘটিকায় ভারতের উত্তর প্রদেশের হারদুয়ী জেলায় নিজ বাড়ীতে ইন্তিকাল করেন। (আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম নসীব করুন! আমীন।) মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৮৮ বছর। মৃত্যুর পর তার ওসীয়ত মুতাবিক নিজস্ব খাস গোরস্থান থাকা সত্ত্বেও হারদূয়ী জেলা শহরের আম কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।