শরীয়ত ও তরীকত
‘সুলূক’ ও ‘তরীকত’ যাকে মানুষ ‘তাসাওউফ বলে থাকে, তার হাকীকত বা মূল কথা এই যে, মুসলমান তার যাহের ও বাতেন তথা ভেতর ও বাহিরকে নেকআমল দ্বারা সজ্জিত করবে এবং বদআমল থেকে দূরে রাখবে। এর বিশ্লেষণ এই যে, মুসলমানের জীবনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তা’আলাকে রাজি-খুশি করা। এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য লাভের উপায় হলো, শরীয়তের হুকুম-আহকাম পরিপূর্ণরূপে মেনে চলা।
এ সংক্রান্ত মাসআলাসমূহকে ‘ইলমে ফিকহ’ বলে। আর কিছু রয়েছে মানুষের অভ্যন্তর তথা অন্তর বিষয়ক বিধান। যেমন, আল্লাহ তা’আলাকে ভালোবাসা, তাঁকে ভয় করা, তাঁকে স্মরণ করা, দুনিয়াকে কম ভালোবাসা, আল্লাহর ইচ্ছার উপর সন্তুষ্ট থাকা, লোভ না করা, ইবাদতের সময় অন্তরকে হাযির রাখা, আল্লাহর কাজকে ইখলাসের সাথে আল্লাহকে রাজি করার উদ্দেশ্যে করা, কাউকে তুচ্ছ মনে না করা, আত্মশ্লাঘায় লিপ্ত না হওয়া, রাগ নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদি। এ সমস্ত স্বভাব-চরিত্র ও গুণাবলিকে ‘সুলূক’, ‘তরীকত’ ও ‘তাসাওউফ’ বলে। শরীয়তের বাহ্যিক বিধানাবলি নামাজ, রোজা ইত্যাদির উপর আমল করা যেমন ফরয-ওয়াজিব। তেমনিভাবে এ সমস্ত অভ্যন্তরীণ বিধানসমূহের উপর আমল করাও কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে ফরয-ওয়াজিব।
শরীয়ত ও তরীকত দু’টি পৃথক জিনিস নয়। শরীয়তের যাহেরী ও বাতেনী সমস্ত হুকুমের উপর পরিপূর্ণ আমল করার নামই ‘তরীকত’।
ইমাম আযম আবু হানীফা (রহ.) ইলমে ফিকহের সংজ্ঞাই এমনভাবে দিয়েছেন, যে সংজ্ঞায় যাহেরী ও বাতেনী আমল সবই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালের আলেমগণ ইলম হাসিলের সুবিধার্থে যাহেরী আমলসমূহ যথা, নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, বিবাহ, তালাক, ব্যবসা, ভাড়া, চুক্তি ইত্যাদি বিষয়সমূহকে পৃথকভাবে সংকলন করে তার নাম দিয়েছেন ইলমে ফিকহ। আর বাতেনী আমলসমূহ যথা, ইখলাস, সবর, শোকর, যুহদ ইত্যাদি আমলসমূহের বিধি-বিধানকে পৃথকভাবে সংকলিত করে তার নাম রেখেছেন তাসাওউফ ও তরীকত।
এ পরিভাষা অনুপাতে শরীয়ত ও তরীকতের একটিকে অপরটি থেকে এভাবে পৃথকও বলা যেতে পারে, যেমন নামাজ অপরটি থেকে এবং রোজা একটি পৃথক ইবাদত। এবং যেমন মানুষের হাত একটি পৃথক অঙ্গ এবং পা একটি পৃথক অঙ্গ। চোখ এক জিনিস আর কায় অন্য জিনিস। অন্তর, কলিজা ও ঠোঁট পৃথক পৃথক অঙ্গ। কিন্তু একটি মানবের পূর্ণতা এ সবগুলোর সমন্বিত রূপেই হয়ে থাকে। এগুলোর একটিকে নিয়ে অপরটি বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। এমনিভাবে পরবর্তীকালের আলেমগণের পরিভাষামতে ইলমে আকায়িদ, ইলমে ফিকহ ও ইলমে তাসাওউফ নিঃসন্দেহে পৃথক পৃথক বিষয় ও শাস্ত্র। কিন্তু সঠিক ও পরিপূর্ণ মানুষ বা মুমিন ও মুসলমান এ সবকিছুর সমন্বয়েই হয়ে থাকে এবং কুরআন ও সুন্নাহর প্রকৃত অনুসরণ এর সবগুলোর উপর আমল করার দ্বারাই লাভ হতে পারে। এগুলোর মধ্য থেকে কোনো একটিকে নিয়ে অন্যগুলোকে এড়িয়ে চলা এমনই ধ্বংসাত্মক, যেমন ধ্বংসাত্মক কানের হেফাজত করে চোখ নষ্ট করা বা রোজার হেফাজত করে নামাজ নষ্ট করা।
হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ (কুদ্দিসা সিররুহু) বলেছেন- ‘তরীকতহীন শরীয়ত নিরেট দর্শন, আর শরীয়তহীন তরীকত ধর্মহীনতা।’ হযরত কাযী সানাউল্লাহ পানিপতী (রহ.) ফরমায়েছেন, ‘যে ব্যক্তির যাহের পাক নয়, তার বাতেন পাক হতেই পারে না।’ যাহের পাক হওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যাহেরী আমলসমূহের পাবন্দী করা, যেগুলো ইলমে ফিকহের মধ্যে বর্ণনা করা হয়। আর বাতেন পাক হওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, বাতেনী আমলসমূহের পাবন্দী করা, যেগুলো বর্ণনা করা হয় ইলমে তাসাওউফ ও সুলূকের মধ্যে। ইমাম সোহরাওয়ার্দী (রহ.) আওয়ারিফুল মাআরিফ কিতাবে সুফিয়ায়ে কেরামের মধ্যে যে সমস্ত অস্বাভাবিক ভাব ও অবস্থা দেখা দেয় সেগুলো সম্পর্কে বলেন যে, হজরত সাহল বিন আবদুল্লাহ বলেছেন-
كُل وَجدِ لا يشهد له الكِتاب والسّنة فَبَاطل
‘যেই উন্মাতাল অবস্থার কোনো সাক্ষ্য কুরআন-সুন্নাহয় মওজুদ নেই, তা বাতিল।’
তারপর তিনি বলেন, সুফিয়ায়ে কেরামের ইত্তিবায়ে সুন্নাতের অবস্থা এই। তাই যে জাহেল বা মূর্খ সূফী এর বিপরীত হালাতের দাবিদার হবে, সে ফেতনায় নিপতিত ডাহা মিথ্যুক। (আওয়ারিফ, ইহইয়াউল উলূমের টীকা -১, পৃঃ ২৮০)
হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর মশহুর ইমাম আবুল কাসিম কুশায়রী (রহ.) সে যুগের সুফিয়ায়ে কেরামের নামে ‘রিসালায়ে কুশায়রিয়া’ নামে যে পয়গাম লিখেছিলেন, তার মধ্যে ইত্তিবায়ে সুন্নাতকেই সমস্ত সূফীর প্রকৃত কর্তব্য আখ্যা দিয়েছেন।
এ থেকে জানা গেলো যে, তাসাওউফের কতক মূর্খ দাবিদার যে বলে, শরীয়ত ও তরীকত দুটি পৃথক রাস্তা, যে কাজ শরীয়তে হারাম তা তরীকতের মধ্যে হালাল হতে পারে। এটি নিশ্চিত ভ্রষ্টতা, সুস্পষ্ট ধর্মহীনতা এবং সমস্ত সূফিয়ায়ে কেরামের মত ও পথের পরিপন্থী কথা।
মাহে জিলহজ্ব ও কুরবানীর ফযীলত করণীয় ও বর্জনীয় || রাহে সুন্নাত ব্লগ
উলামায়ে কেরাম : মর্যাদা, দায়িত্ব ও কর্তব্য
কুরআনুল কারিমের কথা প্রবন্ধটি পড়তে ক্লিক করুন
আরো জানতে ভিজিট করুন আমাদের ওয়েব সাইট রাহে সুন্নাত ব্লগ