সালেকীনদের জন্য জরুরী নসীহত

সালেকীনদের জন্য জরুরী নসীহত (১)
খাদেমুস সুন্নাহ অধ্যক্ষ মুহাম্মদ মিজানুর রহমান চৌধুরী দা. বা.
খলীফা, মুহিউস সুন্নাহ হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক রহ.
نَحْمَدُهٗ وَنُصَلِّىْ عَلٰى رَسُوْلِهِ الْكَرِيْمِ اَمَّا بَعْدُ
১. সময় মানব জীবনের এক অমূল্য পুঁজি, তাই এর যথার্থ মূল্যায়ন ও সঠিক ব্যবহার হওয়া চাই। আর এর জন্য প্রয়োজন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সারাবেলার সকল কাজের একটি রুটিন তৈরী করা। যেন সহজেই সকল কাজ সঠিকভাবে সম্পাদন করা যায়।
২. কিছু সময় বরং সর্বোত্তম সময় তথা ফজরের অব্যবহিত পরের মুহূর্তগুলো বরাদ্দ করা উচিত আল্লাহর যিকির, অযিফা পাঠ, তিলাওয়াতে কালামে পাক ও আদইয়ায়ে মাছুরা তথা হাদীসে বর্ণিত মাসনূন দুআসমূহ পাঠের জন্য। তবে এসব আমল এতটা সংক্ষিপ্ত হওয়া বাঞ্চনীয় যা সহজেই প্রতিদিন করা যায়।
৩. ইত্তিবায়ে সুন্নতের নিয়তে কিছু সময় আপন গৃহে, পরিবার-পরিজনের সাথে কাটানো চাই। এতে তারাও যেমন ভরসা পায়; আন্তরিকভাবে খুশি হয়, নিজের ভেতরেও তেমনি তাদের আন্তরিকতা ও ভালোবাসার ছোঁয়ায় উদ্যম সৃষ্টি হয়। বিষয়টি অনেক পারিবারিক সঙ্কট ও ঝামেলা নিরসনেও সাহায্য করে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন পরিজনের সাথে প্রীতি-ভালোবাসা স্থাপন ও সুন্দর আচরণের প্রতি সবিশেষ তাকিদ দিয়েছেন।
৪. আল্লাহ তাআলা আপন হকের পরই পিতা-মাতার হককে অত্যাবশ্যক করেছেন। জীবদ্দশায় তাঁদের সেবা করা, তাঁদেরকে শারীরিক ও মানসিকভাবে শান্তি দেয়া, সার্বিকভাবে সন্তুষ্ট রাখা এবং তাঁদের দুআ লাভ করা ওয়াজিব। মরণের পরে তাঁদের জন্য তাঁদের পক্ষ থেকে সওয়াব রেসানী করতে থাকা, কালামে পাকের তিলাওয়াত, নাওয়াফেল ও অন্যান্য আদইয়ায়ে মাসনূনাহ, দান-খায়রাত বিশেষত খায়রাতে জারিয়াহ ইত্যাদি করা। নিজে নেককার হওয়া ও নেক আমলে অভ্যস্ত হওয়াই মরহুম পিতা-মাতার জন্য সদকায়ে জারিয়ার মর্যাদা রাখে। হাদীস শরীফে এসেছে, আলমে বরযখে প্রত্যেক সপ্তাহে সন্তানদের আমল মাতা-পিতার সামনে উপস্থাপন করা হয়। সন্তানদের নেক আমল দেখে তারা আনন্দিত ও বদ আমল দেখে ব্যথিত হন। এজন্য মৃত মাতা-পিতার আত্মা যেন কষ্ট না পায় সেদিকে বিশেষ নজর রাখা দরকার; বরং চেষ্টা করা দরকার যেন আমার নেক আমল ও ইসালে সওয়াবের বদৌলতে তাঁদের কবর জগতে উপকার হয়।
৫. ভাই-বোনদের মাঝে পারস্পারিক সৌহার্দ্য ও সুসম্পর্ক বজায় রাখবে। অন্যথায় পারিবারিক শান্তি আজীবন অধরাই থেকে যাবে। জীবনে স্বস্তি ও শান্তি মিলবে না কখনো। ভাইয়ে ভাইয়ে অনৈক্য ও বৈরিতা অনেক অনিষ্ট ডেকে আনে। সকল পারিবারিক কলহের সূচনা হয় পারস্পরিক হক নষ্ট এবং শিশু কিংবা নারীদের কেন্দ্র করে। তারপর শুরু হয় পরস্পর ভূল বুঝাবুঝি। একে অপরের ব্যাপারে কুধারণা পোষণ। ভাল করে বুঝে নাও, হৃদয় পরিচ্ছন্ন রাখ। শুরু থেকেই বোধ ও বিবেক দিয়ে পরিস্থিতি যাচাই কর, যেন কলহ-বিবাদ ও ভুল বুঝাবুঝির সুযোগ-ই না আসে। নয়তো পরবর্তীতে অন্তর ঘোলাটে হয়ে গেলে বিবেকও প্রভাবিত হবে অনুচিত আবেগে। তখন তোমার পক্ষে ইনসাফের সাথে বিচার করা সম্ভব হবে না। আর এই ভুল বিচারই শেষ পর্যন্ত পারিবারিক যত বিবাদ ও অশান্তি সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। প্রত্যেকের উচিত ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে উদারতা, আত্মত্যাগ, ছাড় দেয়া ও তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর ব্যাপারে এড়িয়ে যাবার মানসিকতায় অভ্যস্ত করা। এতে করে নিজেদের মাঝে ভালোবাসা ও প্রীতির পরিবেশ বজায় থাকে। ভুল বুঝাবুঝির ভিত্তিতে যে ঝামেলা বাঁধবে দেরি না করে আলোচনার মাধ্যমে তা মিটিয়ে ফেলবে। নিজে ভুল করলে অকপটে তা স্বীকার করবে। প্রয়োজনে ক্ষমা চেয়ে নিবে।
৬. সন্তানের লালন-পালন পিতা-মাতার এক গুরুদায়িত্ব। জ্ঞানের উন্মেষ হওয়া মাত্র তাদেরকে আল্লাহ-রাসূলের নাম শেখাতে শুরু করবে। কচি বয়সেই কুরআন শরীফ খতম করাবে। পাক-নাপাক, জায়েজ-নাজায়েজ ও হালাল-হারামের জরুরী মাসআলা-মাসাইল সম্পর্কে জ্ঞান দান করবে। শুরু থেকেই নামাযে অভ্যস্ত করে তুলবে। তাদের লেবাস-পোশাক হবে কেবল ইসলামী। তাদের আখলাক ও চরিত্র গঠনের ব্যাপারে যতœ নিবে। উঠা-বসা ও খানা-পিনার সুন্নাত, আদব এবং আদইয়ায়ে মাসূরা শিক্ষা দিবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
“হে ঈমানদারগণ নিজকে এবং নিজের পরিবার-পরিজনকে দোযখ হতে বাঁচাও।”
এই আয়াতের তাফসীরে হযরত আলী রাযি. বলেন, ‘পরিবারবর্গকে ইলমে দ্বীন শিক্ষা দাও।’ -হাকেম
এই হাদীসের দ্বারা প্রমানিত হলো যে, নিজের স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদেরকে ধর্ম বিষয় শিক্ষা দেওয়া ফরয। অন্যথায় পরিণাম ফল দোযখ। -তারগীব
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কোন বাপই নিজ সন্তানকে সু-শিক্ষা দান অর্থাৎ ইলমে দ্বীন শিক্ষা দান অপেক্ষা ভাল সম্পত্তি দান করে নাই। -তিরমিযী
শুধু মুসলমানের সন্তান হলেই মুসলমান হওয়া যায় না। যদি মুসলমানের সন্তানকে ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার অনুশীলনে অভ্যস্ত না করা যায় তাহলে ইসলামী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে মুসলমান সন্তানদের আচার-আচরণ, রীতি-নীতি হয়ে যাবে বিজাতীদের মত।
বিশেষ গুরুত্বের সাথে দুনিয়া ও আখেরাতের প্রয়োজনীয় শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করবে। অসৎ সঙ্গ ও খারাপ সঙ্গী থেকে সন্তানকে অবশ্যই নিরাপদ দূরত্বে রাখবে। আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক গড়ার শিক্ষা দান করবে। সহ শিক্ষা থেকে অবশ্যই দূরে রাখবে।
৭. এ যুগে ঘরের পরিবেশ সম্পূর্ণ ইসলামী হওয়া ওয়াজিব। ঘরে যেন ছবি বা টিভি, বাদ্য বাজনার উপকরণ স্থান না পায়। বর্তমানে উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের চরিত্র নষ্ট হওয়ার বড় মাধ্যম হলো মোবাইল, স্মার্ট ফোন। এর থেকে নিজ ও সন্তানদের বিরত রাখবে।
৮. ইদানিং তথাকথিত ভদ্র পরিবারগুলোতে মেয়েদেরকে অবাধ স্বাধীনতা দেয়া হচ্ছে। এতে সমাজ থেকে হায়া-শরম ও পর্দা-পুশিদা বিদায় নিচ্ছে। মাহরাম ও বেগানার পার্থক্য উঠে যাচ্ছে। ফলে অধিকহারে দেখা দিচ্ছে নৈতিক অবক্ষয়, মারাত্মক অপরাধ প্রবণতাসহ সামাজিক অস্থিরতা। সূতরাং এর অপব্যবহার থেকে কঠোর সতর্কতা অবলম্বন জরুরী।
৯. যাদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রয়েছে তাদের হক আদায় করাও ওয়াজিব। শরীয়তে এর খুব গুরুত্ব রয়েছে। একটি হাদীসের ভাষ্য, আত্মীয়তার বন্ধন ঠিক রাখা শুধু এই নয় যে, তাদের সাথে লেনদেন ভাল রাখবে। এতটুকু তো অনাত্মীয়দেরও প্রাপ্য। আত্মীয়তার বন্ধন ঠিক রাখার অর্থ হলো, এক পক্ষ সম্পর্ক ছিন্ন করলেও তুমি তার সাথে সম্পর্ক রাখবে। একজন হক আদায় না করলে অন্যজন হক আদায়ের দায় থেকে মুক্ত নয়। কোন আত্মীয় যদি সম্পর্ক খারাপ করে বা পীড়া দেয় তাহলে সেটি তার দোষ। তোমার কর্তব্য ও মহত্ব হলো, প্রতিশোধ না নিয়ে তাকে ক্ষমা করা। তাকে মন্দ না বলে, ত্যাগ না করে বিপদে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। এটাই (আত্মীয়তার) সম্পর্ক বজায় ও হক আদায়ের উৎকৃষ্ট পদ্ধতি। সম্ভব হলে জলদি তার সাথে বোঝাপড়া করে নাও। এতেই দুনিয়ার শান্তি এবং আখেরাতের নেকী। শরীয়তের হুকুকুল ইবাদ বা বান্দার হকের ব্যাপারে খুব তাগিদ দেয়া হয়েছে। কেউ যদি নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাহলে শরীয়তের নির্দেশ অবশ্যই তাকে ক্ষমা করো। ক্ষমা না করলে অনেক কঠিন গোনাহ হবে। অনুরূপ দোষ যদি হয় নিজের তাহলে অবশ্যই ক্ষমা চেয়ে নিবে। মন যতই এ ভুলের ব্যাখ্যা খুজে বের করুক না কেন, যতই নিজেকে ছোট মনে হোক না কেন- তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবে না। ক্ষমা চাইলে অপর পক্ষ যদি ক্ষমা না করে তাহলে সে-ই গোনাহগার হবে আর ক্ষমা প্রার্থনাকারীকে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে কোনরূপ ধরপাকড়ের সম্মুখীন হতে হবে না।
১০. প্রতিবেশীদের সাথেও সুসম্পর্ক বজায় রাখা চাই। সদা সতর্ক থাকবে যেন তোমার দ্বারা তারা কোন কষ্ট না পায়। তারাই যদি তোমাকে কষ্ট দেয় তবে তুমি ধৈর্য্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিবে এবং কোমল পদ্ধতিতে তার সাথে বোঝাপড়া করবে।
সালেকীনদের জন্য জরুরী নসীহত (২)
১১. আনন্দ-শোকের নানা সামাজিক অনুষ্ঠান যেখানে বিদআত-কুপ্রথা, গোনাহ ও অশ্লীলতার চর্চা হয়, রুসমী বিবাহ অনুষ্ঠান, মৃত্যু বার্ষিকী, চল্লিশা ইত্যাদি। যতদূর সম্ভব সেসবে অংশগ্রহন থেকে বিরত থাকবে। নিজেদের অনুষ্ঠানে কঠোরভাবে এসব দমন করবে। শরীয়ত লংঘন করার মাঝে কোন প্রকার শান্তি বা বরকত নেই। উপরন্তু দুনিয়াবী ক্ষতি ছাড়াও আখেরাতে ধড়পাকড় আছে।
১২. আপন গৃহে সম্পূর্ণ ইসলামী পরিবেশ কায়েম করা চাই। অন্যথায় পরবর্তী প্রজন্ম এ ব্যাপারে বেপরোয়া হয়ে উঠবে। এতে করে দুনিয়া-আখেরাতের নানা সমস্যা সৃষ্টি হবে। নিজের অবস্থা-অবস্থান, লেবাস-পোশাক, চাল-চলন ও খাওয়া-দাওয়াসহ সবকিছু হওয়া উচিত শরীয়ত-সুন্নাত মাফিক। ঘরের আসবাবপত্র হওয়া চাই সাদামাটা এবং সাফ-সুতরো। কেবল লোক দেখানের ইচ্ছায় সাধ্যের চেয়ে বেশি মূল্যবান আসবাবের সমাবেশ ঘটানো অন্যায় অপব্যয়, যা শুধু অশান্তিই ডেকে আনে। কারণ সারাক্ষণ এসবের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়। কখনো ‘আরো উন্নত’ আরো বেশি‘র বাসনা কিংবা যা আছে তা নষ্ট বা হারিয়ে যাওয়ার চিন্তা মনকে অশান্ত করে তোলে। প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র নিয়েই তো তুষ্টতা বা কানাআত হাসিল করা যায়। পশ্চিমা সভ্যতা আমাদের সমাজকে এতোটা কলূষিত করে চলছে যে, আমরা অজান্তেই এতে প্রবেশ করে নিজেদের পরিচয় এবং চেতনা হারিয়ে বসছি। পরিণামের কথা চিন্তা করলে আমরা সহজেই বুঝতে পারব, দুনিয়া ও আখেরাতের ক্ষতি থেকে বাঁচতে হলে ধর্মীয় মূল্যবোধ, ইসলামী শিষ্টাচার ও আচার-ব্যবহার টিকে রাখার কোন বিকল্প নেই।
১৩. সুস্বাস্থ্য তথা নিরোগ দেহ যতœযোগ্য এক বড় নেআমত। স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে মনও ভালো থাকে না। অতএব স্বাস্থ্য রক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া উচিত। এর জন্য আলবৎ একটি রুটিন মেনে চলা জরুরী। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ে পানাহার, শয়ন, বিনোদন ও হালকা ব্যায়াম এক কথায় সকল কাজের জন্য সময় নির্ধারণ করা যেন সব কাজ যথাসময়ে সহজে সম্পাদন করা যায়। আর যদি (আল্লাহ না করুন) কোন রোগ-ব্যাধি হয়ে যায় তাহলে নিশ্চিন্তে বসে না থেকে এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করবে।
১৪. জীবন মাত্রেই অপরের সাথে হৃদ্যতা-ঘনিষ্টতা হবেই। কিন্তু তারপরও এটি শুধু একান্ত প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। অকারণ ঘণিষ্টতা চাই তা স্বজন, বান্ধব, ব্যবসায়িক পার্টনার বা যার সাথেই হোক না কেন কোন না কোন পর্যায়ে গিয়ে তা বিড়ম্বনা বা পেরেশানী ডেকে আনে। কারণ সবার মন খুশি করা দুরূহ ব্যাপার। আর কাউকে খুশি না করতে পারলেই মন অস্থির হয়। দেয়া যায় এসব অদরকারী সম্পর্কে নিজের কোন অপারগতা হেতু অন্যের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে সে-ও আঘাত পায় আবার নিজের কাছেও নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আবার অনেক লোক আপন স্বার্থ লাভের জন্যেও গতানুগতিক বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়, অনেক সময় যা আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় অথবা সে-ই ঘটিয়ে বসে শান্তি বিনাশী কোন ব্যাপার। সূতরাং যার তার উপর আস্থা রাখতে নেই।
১৫. যথাসম্ভব জীবনের প্রতিটি কাজে শরীয়তের আহকাম ও সুন্নাতের আনুগত্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিবে।
১৬. সর্বদা নেককারদের সঙ্গ অবলম্বন করবে। বন্ধু নির্বাচনের বেলায় খুব সতর্কতার সাথে কাজ করবে। শুধু বাহ্যিক আচার-ব্যবহার দেখেই মজে যাবে না। সততা, নিষ্ঠা, দ্বীনদারী এবং লেনদেনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতাই মানুষের ভালো-মন্দের মাপকাঠি।
১৭. জীবন যাপন করতে গিয়ে বারবার যাদের শরণাপন্ন হতে হয়, খুব ভেবে চিন্তে তাদের বাছাই করবে। যেমন- ডাক্তার, উকিল, ব্যবসায়ী প্রমুখ।
১৮. আপন ঘরের অবস্থাদি এবং ঘরোয়া গোপন কথা কখনো অন্যের কাছে বিশেষত নারীদের কাছে ব্যক্ত করবে না।
১৯. অনাবশ্যক ব্যস্ততা মনের শান্তি কেড়ে নেয়। যেমন- গায়ে পড়ে অন্যের ব্যাপারে নাক গলানো, কাউকে খুশি করতে গিয়ে অপরের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়, কারো আমানত নেয়া বা জামিন হওয়া ইত্যাদি। কারণ বর্তমান ফেতনার যুগে এসব কাজ প্রায় ক্ষেত্রেই ঝামেলা বা বিপদ ডেকে আনে। প্রত্যাশা মতো না হয়ে একটি এদিক- সেদিক হলেই সমালোচনার দুয়ার খুলে যায়। দূর হয়ে যায় চিত্তের স্থিরতা। হৃদয়ে ভর করে চিন্তা ও উৎকণ্ঠা। যেমন- নিজে বা পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ল অথবা অভাবিত দারিদ্রের শিকার হলো কিংবা অপ্রত্যাশিতভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে বা অর্থ-সম্পদে লোকসানের মুখে পড়ল, এসবই মানুষের স্বপ্ন ও আবেগকে চুরমার করে দেয়। এসব পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সংশয় দূর করতে ও আত্মিক প্রশান্তি লাভ করতে আল্লাহ ও তদীয় রাসূল কর্তৃক বাতলানো তদবির গ্রহন করবে। চিন্তা ও টেনশন ঐচ্ছিক হোক আর অনৈচ্ছিক সর্বাবস্থায় তা মনের শান্তি ও স্থিরতা দূর করে দেয়। তবে মুমিনের অন্তরে আল্লাহ তাআলা এমন যোগ্যতা রেখেছেন যে, এমন টেনশনের মুহূর্তেও যখন সে কোনভাবে নিজের প্রকৃত মালিকের দিকে প্রত্যাবর্তন করে তখন অবশ্যই মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পায়। টেনশনের বাহ্যিক প্রতিক্রিয়া অবশিষ্ট থাকলেও তা সহ্যের মধ্যে থাকে। এসব পরিস্থিতিতে আল্লাহওয়ালা বুযূর্গদের শরণাপন্ন হলে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়। তাঁদের দুআ ও সহমর্মিতামূলক বাক্য অন্তরে শক্তি সঞ্চার করে। তাই দেখা যায় যারা ক্লেদহীন পবিত্র জীবন যাপন করেন, যাদের অন্তরে দ্বীনের গুরুত্ব ও মহব্বত আছে এবং অযিফা, দুআ-দরূদ ও নামাযের পাবন্দি করেন আবার কোন বুযূর্গের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সম্পর্কও রাখেন, তাদের দেহ-মন পার্থিব চিন্তা-পেরেশানি দ্বারা খুব কমই প্রভাবিত হয়।
বাস্তবিকপক্ষেই বান্দা তার দুনিয়াবী ঝামেলা ও পেরেশানির মুহূর্তে আপন মাওলা ও প্রকৃত মালিক সমীপে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে মনে ভরসা পেতে পারে। অর্জন করতে পারে চিন্তা ও পেরেশানি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় ধৈর্য্য ও সাহস।
আল্লাহ জাল্লাশানুহু আপন কালামে পাকে এবং রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় হাদীস ভা-ারে আমাদের চিন্তা-টেনশন ও বিপদ দূর করণার্থে অনেক দুআ ও তদবীর শিক্ষা দিয়েছেন। বিপদকালে এসবের উপর আমল করবে। আপন ত্রুটি-বিচ্যুতি ও বদ আমলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে এবং সদকা-খায়রাত করবে। এসব করলে দৃশ্যত কষ্ট ও বিপদ অবশিষ্ট থাকলেও আল্লাহর মর্জির উপর হৃদয় শান্ত হয়ে যায়। আর এটি এক বড় নিআমত।
২০. দ্বীনি ইলম হাসিল করা অত্যন্ত জরুরী। কারণ ইলম ছাড়া জীবনের লক্ষ্য স্থির করা যায় না। কয়েক ধরনের কিতাব পাঠ খুবই দরকারী। যেমন- সাইয়েদ সুলাইমান নদভী রহ. কৃত ‘সীরাতুন নবী’, সাহাবা ও বুযূর্গানে দ্বীনের জীবন চরিত, তারিখে ইসলাম বা ইসলামের ইতিহাস এবং হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. কর্তৃক রচিত কিতাবাদী। বিশেষত তাঁর মাওয়ায়েজ, কামালাতে আশরাফিয়া, ইসলামের সৌন্দর্য ও বেহেশতি জেওর, তালীমুস সুন্নাহ, কছদুছ ছাবীল, রাহে তরীকত মামুলাতে আবরার, তাবলীগে দ্বীন, হায়াতুল মুসলিমীন, ইসলাহে মুআশারাত, ছাফায়ে মুআমালাত, মাজালিসে আবরার ইত্যাদি আরো কিতাব নিজ দ্বীনি মুরুব্বী থেকে পরামর্শ করে সব সময় পড়তে থাকা। এসকল কিতাব অধ্যয়নের দ্বারা দুনিয়া-আখেরাতের মূল্যবান জ্ঞান হাসিল হয়। উদ্দেশ্যহীন অনর্থক কিতাবাদী যেমন- পেপার-পত্রিকা ও নভেল-নাটক পড়ে মূল্যবান সময় নষ্ট করবে না। এতে হৃদয়ে অন্ধকার এবং বোধ ও চিন্তায় সংকীর্ণতা তৈরী হয়। অন্য ধর্মের গ্রন্থাদি কখনো পড়া উচিত নয়। কেননা ইসলামের গভীর জ্ঞান ছাড়া অন্য ধর্মের আকীদা-দর্শন পাঠ করলে মস্তিস্ক প্রভাবিত এবং চিন্তা বিকৃত হতে পারে। এতে গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। আর নিজ ধর্মের ব্যাপারে মনে কোন প্রশ্নের উদয় হলে অবশ্যই কোন আলেমের কাছে গিয়ে তা নিরসন করে নিবে।
সালেকীনদের জন্য জরুরী নসীহত (৩)
কয়েকটি বাতেনী বা অন্তরগত আমল
২১. সর্বদা নিজের বর্তমান অবস্থায় সন্তুষ্ট থেকে শুকরিয়া আদায় করবে। নিজের জীবন যাপন প্রণালী, জীবনের প্রয়োজনাদি এবং পরিবার-পরিজন ও পরিবেশ-প্রতিবিশীর প্রতি সদা নজর দিবে আর ভাববে, বর্তমান অবস্থা যাই হোক সবচেয়ে বড় নিআমত তো এই পেয়েছি যে, নিরাপদ ঈমান ও দ্বীন ইসলামের উপর আছি। এ মহা দৌলত না চাইতেই আল্লাহ তাআলা আমাকে দান করেছেন।
অতঃপর স্বীয় অস্তিত্বে নিআমতের প্রতি লক্ষ্য করবে। আপন পরিবেশের শান্তির দিকগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিবে। খেয়াল করবে নিজ পরিবারের সুদিনগুলো। মনে করবে অন্যদের সঙ্গে তোমার সুসম্পর্কের কথা। তারপর হৃদয়ের গভীর থেকে আল্লাহ প্রদত্ত এসব নিআমতের শোকর আদায় করবে। এছাড়া তুমি যে অবস্থায়ই থাকো না কেন গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখবে, আল্লাহর লাখো মাখলুক আছে যারা তোমাকে প্রদত্ত এসব নিআমত থেকেও বঞ্চিত। সূতরাং বর্তমান অবস্থাকেও খোদার বিশেষ অনুগ্রহ ও দান মনে করে শোকর আদায় করবে। এভাবে প্রতিটি নিআমতের প্রতি আলাদা আলাদাভাবে নজর বুলাতে থাকবে। এটি অশান্তির মুহূর্তগুলোয় শান্তি লাভের এক সুন্দর কৌশল।
আমার এ পরামর্শগুলো মেনে দেখো শান্তি পাও কি-না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যে কেউ নিআমতের শুকরিয়া আদায় করবে তিনি তাঁর নিআমতকে অবশ্যই বৃদ্ধি করে দেবেন। দান করবেন বরকত ও সমৃদ্ধি। আল্লাহ তাআলার বে-শুমার নিআমত রাজির জন্য সদা সর্বদা কালিমাতুশ্শোকর এবং সালাতুশ্শোকর আদায় করতে থাকবে।
২২. নিজের অপরাধ, ত্রুটি-বিচ্যুতি ও গোনাহের কথা স্মরণ করে বেশি বেশি তওবা-ইস্তিগফার করবে। আল্লাহ তাআলা ওয়াদা করেছেন, যে বান্দা আপন কৃতকর্মের উপর অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করবে তাকে ক্ষমা ও মাফ করা হবে। ইস্তিগফার এক বড় নিআমত, বড় এক অবলম্বন। দয়াময় খোদা অনুতপ্ত গোনাহগার বান্দাকে খুবই পছন্দ করেন। তাদেরকে সানন্দে আপন ক্ষমা ও দয়ায় সিক্ত করেন। তাই আল্লাহর দরবারে কৃত অপরাধ ও গোনাহ স্বীকার করতে থাকবে। তাওবা-ইস্তিগফার করতে পারা সৌভাগ্যপূর্ণ মৃত্যুর অন্যতম নির্দশন।
২৩. সম্প্রতি ফিতনা-ফাসাদ এতোই বেড়ে চলছে, জীবনের প্রতিটি শাখায় বদদ্বীনী ও ধ্বংসের উপায়-উপকরণ এতোই বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, তা অনুমান করা কঠিন। তদুপরি অজ¯্র ফিতনা প্রকাশ পাচ্ছে যা সরাসরি ইসলাম-বিরুদ্ধ হওয়া ছাড়াও সমাজের শান্তি-শৃংখলা বিনষ্ট করছে। মানুষের লেনদেন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। স্বার্থপরতা ও অপরের অনিষ্ট সাধনের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দিনদিন সমাজে জেঁকে বসছে পাশ্চাত্য সভ্যতার অভিশাপ। জীবন যাপন পদ্ধতি, পানাহার, লেবাস-পোশাকসহ সবই হয়ে পড়ছে প্রদর্শনপ্রিয়তা ও লৌকিকতা নির্ভর। নিত্য নতুন জটিল থেকে জটিলতর রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। খাদ্য, বাতাস ও প্রকৃতি দূষিত হয়ে পড়ছে। নতুন নতুন ঔষধ ও ভ্যাকসিনের দ্বারা রোগ আরো জটিল আকার ধারণ করছে। চারদিকে প্রকাশ পাচ্ছে ধোঁকা, প্রতারণা ও ওয়াদা খেলাপিসহ নানা চরিত্র বিধ্বংসী অভ্যাস। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কয় হলো, বদদ্বীনি সয়লাভ। তরুণ প্রজন্ম ইসলাম থেকে ক্রমশ শুধু বেপরোয়াই হচ্ছে না; বরং নিজেদের অজ্ঞতা, অনাড়িপনা এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় বেহুঁশ হয়ে দ্বীনের দুশমনে পরিণত হচ্ছে। শুচিতা ও পবিত্রতা শুধু হারিয়েই যাচ্ছে না এর গুরুত্বই উঠে যাচ্ছে মানুষের মন-মানস থেকে। আল্লাহ-রাসূলের বাণী সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না রাখার ফলে ইসলামকে বাতিল ও আমল-অনুশীলনের অযোগ্য ভাবতে শুরু করেছে। মর্ডান কালচারের নামে অপসংস্কৃতি চরিত্র বিনাশী সব কিছুকে স্বাগতম জানানো হচ্ছে। বেহায়া-বেলেল্লাপনা, বেপর্দা-অশ্লীলতা, নৃত্য-গীত এবং উলঙ্গ-কুরুচিপূর্ণ ছবি ও চিত্রের ব্যবহার নির্দোষ ও সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সামান্য ইংরেজী জানা, পশ্চিমা সভ্যতার খানিক ছোঁয়া পাওয়া নবীন ব্যক্তিও ধর্মের সংস্কারে, দ্বীনের ব্যাপারে অমূলক সংশয় প্রশ্ন উত্থাপনে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। ফল এই দাঁড়াচ্ছে, ইসলামের মৌল চেতনা থেকে বিচ্যুত এক ধর্মহীন জীবনের ঝাপটা প্রতিদিন আরো সফলভাবে সমাজের শিরা-উপশিরায় আছড়ে পড়ছে।
কী এর প্রতিকার? এর থেকে বাঁচার কী উপায়? হ্যাঁ। কর্তব্য হলো, যত বেশি সম্ভব গভীর মনোযোগের সঙ্গে ধর্মীয় কিতাবাদি অধ্যয়ন করবে। বিশেষতঃ আকীদার বিশুদ্ধতা যেসব বিষয়ের উপর নির্ভরশীল সেসব বিষয় ভালো করে জানবে। অতঃপর মুআমালা, ইবাদত, ইসলামী মুআশারা ও আখলাক সংক্রান্ত বিষয়াবলী বিশুদ্ধরূপে হৃদয়াঙ্গম করবে। পূর্ণাঙ্গ ইসলাম সম্পর্কে জানতে হবে, শিখতে হবে এবং আমল করতে হবে। পরিপূর্ণ দ্বীনের একটি আসর প্রভাব তখনই প্রতিফলিত হবে যখন তা বাস্তবায়ন হবে। বর্তমানে দ্বীনের পূর্ণাঙ্গ নকশা দুনিয়ার কোন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির বা জনপদে বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। খোলাফায়ে রাশেদার যুগ এবং বর্তমান মুসলমানদের দেশ, গোষ্ঠি, জীবন-যাপন পদ্ধতি আকাশ-পাতাল দূরত্ব ও বৈপরিত্ব এসে গেছে। কাজেই পরিপূর্ণ ইসলামের সর্বপ্রথম যে বিষয়ে প্রতিটি মুসলমানকে ইলম হাসিল করে নিজেকে সে মুতাবেক গড়ে তুলতে হবে তার ৫টি শাখা রয়েছে। যেমন- ১. আকাইদ ২. ইবাদত ৩. আখলাক ৪. মুআমালাত ৫. মুআশারাত।
১ম শাখা আকাঈদ : এর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রুকন রয়েছে- ১. তাওহীদ ২. রিসালাত ৩. কিয়ামত ও আখেরাতের বিশ্বাস। এগুলো হলো ইসলামের বুনিয়াদী আকীদাহ। এই জন্য তাতে খুব মজবুত হওয়া চাই। কেননা যদি এ‘তেকাদ সঠিক না হয় তাহলে কোন ইবাদতই গ্রহনযোগ্য হবে না।
তাওহীদ : এক আল্লাহ তা‘আলার সত্ত্বাকে মা‘বুদ ও মাসজুদ মনে করা। তাকে সৃষ্টি কর্তা, মালিক, রিযিক দাতা, সম্মান ও অপমান করনেওয়ালা বিশ্বাস করা।
রিসালাত : এই বিশ্বাস রাখা যে, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় মাখলুকের হেদায়াতের জন্য অনেক নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন। যার মধ্যে সর্বশেষ রাসূল সায়্যিদুনা হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবী ও রাসূল আসবে না। এমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা আপন কিতাবসমূহও নাযিল করেছেন। যার মধ্যে সর্বশেষ কিতাব কুরআন মাজীদ। তার মধ্যে কিয়ামত পর্যন্ত সকল মাসআলা-মাসাইল এর পূর্ণাঙ্গ সমাধান বিদ্যমান।
কিয়ামত ও আখেরাত : কিয়ামত ও আখেরাতের হিসাব-নিকাশ। যখন পূর্ণ জগত ধ্বংস হয়ে যাবে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা পূর্ণ জগতকে পূনরায় সৃষ্টি করবেন এবং সকলের হিসাব-নিকাশ হবে। তাদের মধ্যে যারা নেককার তারা আল্লাহ পাকের দয়া ও অনুগ্রহে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যারা বদকার তাদের ঠিকানা জাহান্নাম হবে।
২য় শাখা ইবাদাত : ইবাদতের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো চারটি- ১. নামাজ ২. রোযা ৩. যাকাত ৪. হজ্ব। এগুলো হলো ইসলামের বড় রুকন। যা আদায় করা অত্যন্ত জরুরী। এগুলো আদায় করা ব্যতিত কেহই মুক্তি পাবে না।
৩য় শাখা আখলাক : আখলাক বাতেনী আমলকে বলা হয়। বাতেনকে ইসলাহ করা আবশ্যক। কেননা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- اِنَّمَا بُعِثْتُ لِاُ تَمِّمَ مَكَارِمَ الْاَخْلَاقِ “আমি উৎকৃষ্ট চরিত্রকে পূর্ণাঙ্গ করার জন্যে প্রেরিত হয়েছি।” -সুনানে বায়হাকী
আখলাক দুই প্রকার : ১. উত্তম আখলাক (সৎ চরিত্র) যেমন- ইখলাস (একনিষ্ঠতা) তাওয়াযু‘ (নম্রতা) তাওয়াক্কুল (ভরসা) যুহদ (সাধনা) ইত্যাদি। যেগুলো নিজের মধ্যে অর্জন করা জরুরী।
২. বদ আখলাক (অসৎ চরিত্র) যেমন- কিবির (অহংকার) ক্রোধ, হিংসা, বিদ্ধেষ, লোভ-লালসা ইত্যাদি। যেগুলো নিজের দিল থেকে বের করা জরুরী। তাকেই তাযকিয়ায়ে নফস অর্থাৎ অত্মশুদ্ধি বলা হয়। যার আলোচনা কুরআন হাদীসে রয়েছে। এগুলোকে ঠিক করার জন্য পীর মাশাইখগণের সাথে সর্ম্পক রাখতে হবে।
৪র্থ শাখা মুআমালাত : ক্রয়-বিক্রয়, পরস্পর লেন-দেন এর জন্য শরীয়তে ইসলামী নিয়ম-কানুন, হুকুম-আহকাম নাযিল করেছেন। কাজেই উলামায়ে কেরাম থেকে মাসআলা জেনে তার উপর আমল করা আবশ্যক।
৫ম শাখা মুআশারাত : পরস্পর চলা-ফেরা, উঠা-বসার জন্য শরীয়তে ইসলামী আদব নির্ধারণ করে দিয়েছে। যদি এসকল আদবের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয় তাহলে কেউ কারো থেকে কোন কষ্ট পাবে না। কিন্তু আফসোস! এর দিকে সাধারণত কেউই খেয়াল করে না।
ইলম-এর প্রয়োজনীয়তা : প্রকাশ থাকে যে, এসকল শাখার আমলসমূহকে শরীয়ত সম্মত সঠিক পদ্ধতিতে আদায় করার জন্য সঠিক ইলম জরুরী। এই জন্য আমাদের সকল মুসলমানকে উলামা মাশাইখগণের সান্নিধ্য গ্রহন করা এবং তাঁদের লিখিত কিতাবসমূহ পড়া জরুরী। (এ ব্যাপারে স্বীয় শাইখের পরামর্শ গ্রহন করাই ভাল।)
এ সকল আকীদা ও আমল সঠিক এবং আদায় করার পর যদি কিছু সময় সুযোগ হয় তাহলে কুরআন-হাদীস ও বযূর্গানে দ্বীনের নির্বচিত ওযীফার পাবন্দী করতে পারা নিজের জন্য সৌভাগ্য মনে করা। এছাড়াও রোজ সকাল-বিকাল নামাযের পর প্রত্যেক জাহেরী ও বাতেনী এবং আসমানী ও জমিনী ফিতনা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইবে- নিজের জন্য, আত্মীয়-স্বজন ও সকল মুসলমানের জন্য। ইনশাআল্লাহ যাবতীয় ফিতনা ও বালা-মুসিবত থেকে নিরাপদ থাকবে।
উল্লেখিত বিষয়গুলো মেনে চলতে চাইলে করণীয় হলো, বারবার এসব পড়ে দেখবে। যেগুলোর আমল শুরু করা হয়নি সেসব চিহ্নিত করবে এবং আমল করার জন্য সযত্ম প্রয়াস শুরু করবে। কোন কিছু বারংবার পড়লে, পুনরাবৃত্তি করতে থাকলে দেখা যায় সময়মত বিষয়টি স্মরণে আসে। তখন শুধু দরকার সাহস করে আমল শুরু করা। কিছুদিন এমন করলেই দেখবে আমলের জন্য ভেতর থেকেই তাকিদ বোধ করছ।
সালেকীনদের জন্য জরুরী নসীহত (৪)
২৪. অভিজ্ঞতা সাক্ষী আবার জ্ঞানেরও দাবী এই যে, কোন বিষয় বা কোন বিদ্যায় পারদর্শী হতে হলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ মুরুব্বি অত্যাবশ্যক। কাঙ্খিত মানে শিক্ষা হাসিলে তার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ খুব কাজে আসে। মুরুব্বির তত্ত্বাবধানে অর্জিত জ্ঞান বা বিদ্যা সর্বদা নির্ভরযোগ্য, ত্রুটিহীন ও ক্ষতিমুক্ত হয়ে থাকে। তাই দুনিয়া ও আখেরাতের সহীহ ইলম হাসিলের জন্যও জরুরী, কোন আল্লাহওয়ালার সঙ্গে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক কায়েম করা।
আল্লাহওয়ালার নিদর্শন, তিনি প্রকাশ্যে শরীয়ত ও সুন্নাতের অনুসারী, জাহেরী ও বাতেনী ইলমের অধিকারী এবং স্নেহপরায়ন ও পরহিতৈষী হবে। আর তার সাথে সম্পর্ক রাখার অর্থ, তার সান্নিধ্যে বারবার যাবে। দূরে থাকলে পত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখবে। তাকে দ্বীনের কথা জিজ্ঞেস করবে। তার পরামর্শ অনুযায়ী চলবে। নিজের আভ্যন্তরীণ দোষ-ত্রুটিসমূহ তাকে জানাবে এবং সেসব দূর করতে তার নির্দেশনা মেনে চলবে। আর সবসময় তাকে দিয়ে দুআ করিয়ে নিবে। দৈনন্দিন জীবনে শরীয়তের খেলাপ কিছু হলেই তাকে জিজ্ঞেস করবে। তিনি যা-ই বলেন নিষ্ঠার সাথে তদনুযায়ী আমল করবে।
২৫. নেকি অর্জনের পাশাপাশি গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা জরুরী। হযরতওয়ালা মুহিউস সুন্নাহ (রহ.) বলেন, যদি শক্তিশালী কোন পাহলোয়ানকে কোন বিষ খাওয়ানো হয় অথবা ভুলক্রমে খেয়ে ফেলে তাহলে তার সমস্ত শক্তি খতম হয়ে যাবে। এমনকি জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ হবে।
২৬. উম্মাতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জামাতের মতাদর্শের অনুসরণ জরুরী। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ‘তোমরা সকলে আল্লাহর রুজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ – আলে ইমরান ১০৩
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলা আমার উম্মতকে গোমরাহীর উপর ঐক্যবদ্ধ করবেন না। (অর্থাৎ, এ উম্মতের সবাই একসাথে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না।) আর আল্লাহর হাত ও সাহায্য রয়েছে (মুসলমানদের) সংখ্যাগরিষ্ঠ জামাতের সঙ্গে। যে ব্যক্তি (সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মত ও পথ থেকে) বিচ্ছিন্ন হয়, সে মূলত জাহান্নাম অভিমুখেই তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। (অর্থাৎ এ বিচ্ছিন্নতা তাকে জাহান্নামে পতিত করবে।)
২৭. অপরের ইসলাহের মেহনত জরুরী। কুরআনে পাকে মহান আল্লাহ সৎকাজের নির্দেশের পাশাপাশি অন্যায় কাজের প্রতিরোধের কথাও উল্লেখ করেছেন, যা দ্বারা এর বিশেষ গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। আর যেমনিভাবে ‘‘আমর বিল মারূফ’’ বা সৎকাজের আদেশ দানের জন্য একটি দল থাকা চাই; ঠিক তেমনিভাবে অন্যায় ও অসৎ কাজের প্রতিরোধের জন্যও একটি বিশেষ জামাআত থাকা চাই।
কেননা আল্লাহ পাক বলেছেন, وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
‘‘তোমাদের মধ্যে এমন এক শ্রেণী থাকা চাই, যারা কল্যাণের প্রতি মানুষকে আহবান করবে, আর সৎকাজের নির্দেশ দিবে, মন্দ কাজে বাঁধা দিবে।’’ -আলে ইমরান-১০৪
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দিন। সুন্দর শান্তিময় আলোকিত জীবন গড়ার তাওফীক দিন।
দ্বীনি ইলম শিক্ষা সকলের জরুরী : প্রকাশ থাকে যে, সকল শাখার আমলসমূহকে শরীয়তসম্মত সঠিক পদ্ধতিতে আদায় করার জন্য সঠিক ইলম জরুরী। এজন্য আমাদের সকল মুসলমানকে উলামা মাশাইখগণের সান্নিধ্য অর্জন করা ও তাদের লিখিত কিতাবসমূহ পড়া জরুরী।
উপরোল্লিখিত বিষয়সমূহ ইলম অর্জনের পর নিজ শাইখের পরামর্শক্রমে নিয়মিতভাবে জিকির আযকার করা অবশ্য কর্তব্য। এবং নিজের সার্বিক অবস্থা শাইখের সাথে পরামর্শ করা বাঞ্চনীয়।
রহমান-রাহীম-কারীম আল্লাহ তাআলার কাছে ফরিয়াদ, তিনি যেন এ মেহনতকে কবুল করেন এবং আমাদের সকলের যিন্দেগীতে বে-শুমার বরকত দান করেন। আমীন।