ইবাদতনামায

ইসলামের দৃষ্টিতে নামাজ। নামাজ আমার চোখের শীতলতা

ইসলামের দৃষ্টিতে নামাজ

ইসলামের দৃষ্টিতে নামাজ
নামাজ মুমিন-মুসলমানের বড় হাতিয়ার,
নামাজ ছেড়ে মানুষ শুধু করছে হাহাকার।
ইসলামের দৃষ্টিতে নামাজ সম্পর্কে কিছু তথ্যভিত্তিক আলোচনা লিখার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ!
প্রিয় পাঠক!
ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হচ্ছে নামাজ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ১২১ বার নামাজের কথা উল্লেখ করেছেন। মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন সৃষ্টির সেরা জীন ও ইনসানকে সৃষ্টি করার পর দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দিলেন-
حَافِظُوْا عَلٰى الصَّلَواتِ وَ الصَّلٰوةِ الْوُسْطٰى
অর্থ : তোমরা সমস্ত নামাজের প্রতি যত্নবান হও, বিশেষভাবে মধ্যবর্তী নামাজের ব্যাপারে। -সূরা বাকারা, আয়াত : ২৩৪
হাদীসে পাকে ইরশাদ হয়েছে-
عَنْ ابْنِ عُمَرٌ (رضـ) قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلّٰى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ بُنِىَ الْاِسْلَامُ عَلٰى خَمْسٍ شَهَادَةِ اَنْ لَا اِلٰهَ اِلَّا اللهُ وَ اَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَ رَسُوْلُه وَاِقَامِ الصَّلٰوةِ وَ اِيْتَاءِ الزَّكَوَاةِ وَ الْحَجِّ وَ صَوْمِ رَمَضَانِ ـ متفق عليه
ইসলামের ভিত্তি রাখা হয়েছে পাঁচটি জিনিসের ওপর, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল—এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া, নামাজ কায়েম করা, যাকাত আদায় করা এবং রমযানের রোযা রাখা। -বুখারী ও মুসলিম।
মহান আল্লাহ জিন এবং ইনসানকে কেবলমাত্র ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। আর এই ইবাদত বন্দেগির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো নামাজ। নামাজে দুনিয়া ও আখেরাতে অসংখ্য ফায়েদা রয়েছে-
১. নামাজ পবিত্রতার অভ্যাস গড়ে তোলে;
২. নামাজ মানুষকে সময়ের পাবন্দ হওয়ার শিক্ষা দেয়;
৩. নামাজের দ্বারা সকালে সকালে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস সৃষ্টি হয়;
৪. নামাজের বরকতে গুনাহ থেকে বাঁচা সহজ হয়;
৫. জামাতে নামাজ আদায় করার দ্বারা পরস্পরে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়;
৬. নামাজ কবরে প্রদীপের কাজ দেয়;
৭. নামাজ আখেরাতের উত্তম পাথেয়;
৮. নামাজের দ্বারা দিলে প্রশান্তি সৃষ্টি হয়;
৯. নামাজের দ্বারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়;
১০. নামাজে অভ্যস্ত হওয়ার দ্বারা কেয়ামতের দিন সরওয়ারে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফায়াত লাভের সম্ভাবনা রয়েছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে নামাজ
ইসলামের দৃষ্টিতে নামাজ

নামাজই মুমিন ও কাফেরের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী। নামাজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম একটি স্তম্ভ। নামাজের ফযিলত ও গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে ইরশাদ হচ্ছে-

وَأَقِيمُوا وُجُوهَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍ
অর্থ : তোমরা প্রত্যেক নামাজের সময় তোমাদের দিক ঠিক করো।
-সূরা আ’রাফ, আয়াত : ২৯
الصَّلٰوةُ عِمَادُ الدِّيْنِ مَنْ اَقَامَهَا فَقَدْ اَقَامَ الدِّيْنِ وَ مَنْ تَرَكَهَا فَقَدْ هَدَمَ الدِّيْنِ.
অর্থ : নামাজ হলো দীনের স্তম্ভ। সুতরাং যে নামাজকে কায়েম করল   সে দীনকে কায়েম করল, আর যে নামাজকে তরক করল, সে দীনকে    ধ্বংস করল।
জামে সগীর ও শু‘আবুল ঈমান লিল বায়হাকী: ৪/৩০০ এ প্রসিদ্ধ আছে,
اَلصَّلوٰةُ مِعْرَاجُ الْمُؤْمِنِيْنَ.
অর্থ : নামাজ মুমিনের মে’রাজস্বরূপ।
কুরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছে-
إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ.
অর্থ : নিশ্চয়ই নামাজ সকল প্রকার নির্লজ্জ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। -সূরা আনকাবুত, আয়াত : ৪৫
আরও ইরশাদ হচ্ছে-
وَاَقِيْمُوْا الصَّلَوةَ وَ اَتُوْا الزَّكَوةَ الخ.
অর্থ : তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং যাকাত দাও। -সূরা বাকারা, আয়াত : ৩
প্রিয় পাঠক!
ইসলামে নামাজের চেয়ে বড় কোনো আমল নেই। একমাত্র নামাজ মানুষকে সর্বপ্রকার অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে। পবিত্র কুরআনে আরও ইরশাদ হচ্ছে-
الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ.
অর্থ : যারা গায়েবের ওপর ঈমান আনে এবং নামাজ কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। -সূরা বাকারা, আয়াত : ৪
ঈমানের পর সবচেয়ে ফযিলতপূর্ণ আমল হলো নামাজ। নামাজ মহান রাব্বুল আলামীনের ফরয বিধান। আর মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নামাজ। তাইতো আল্লাহ পাক এদিকে ইঙ্গিত করে ইরশাদ করেছেন-
وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ ۚ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ ۚ ذ‌ٰلِكَ ذِكْرىٰ لِلذَّاكِرِيْنَ .
অর্থ : আর দিনের দু’প্রান্তেই নামাজ ঠিক রাখবে এবং রাতের ও প্রান্তভাগে; পুণ্য কাজ অবশ্যই পাপ দূর করে দেয়। -সূরা হুদ, আয়াত : ১১৪
এমনিভাবে নামাজের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমের একটি নয় দু’টি নয় ১০৯ জায়গায় সুস্পষ্টভাবে আর বাকি ৭০০ জায়গায় ইশারা ইঙ্গিতে নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। আর নামাজ পড়তে গিয়ে এর সময়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হয়েছে এভাবে-
إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَّوْقُوتًا.
অর্থ : নিশ্চয়ই নামাজ মুসলমানদের ওপর ফরয নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। -সূরা নিসা, আয়াত : ১০৪
তাওহীদের পর প্রথম হুকুম ছিল নামাজের। নবুওয়াতের প্রথম যামানায় সূরায়ে মুদ্দাসসিরে ইঙ্গিতে নামাজের হুকুম দেওয়া হয়েছে। যেমন ইরশাদ হচ্ছে-
قُمْ فَأَنذِرْ ـ  وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ ـ
দাঁড়াও, ভীতিপ্রদর্শন করো এবং তোমার রবের বড়ত্ব ঘোষণা করো। -সূরা মুদ্দাসসির, আয়াত : ২-৩
উল্লেখিত আয়াত দ্বারা নামাজের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায়।
এমনিভাবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম যখন কোনো সমস্যায় পড়তেন তখন তাঁরা নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। যেমন ইরশাদ হচ্ছে-
اِذَا فَزَعَه اَمْرٌ بَادَرَ اِلٰى الصَّلٰوةِ ـ
অর্থ : যখন তাঁর কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তখন তিনি নামাজের দিকে ত্বরা করেন। -বুখারী শরীফ
এমনিভাবে যাঁরা পূর্ণ খুশুখুযূ ও একাগ্রতার সাথে নামাজ আদায় করে তাদেরকে শুভসংবাদ দিচ্ছে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এ বাণী-
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ . الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ .
অর্থ : মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্র। -সূরা মু’মিনুন, আয়াত : ১-২
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে-
وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ.
অর্থ : নিঃসন্দেহে নামাজ যথেষ্ট কঠিন কাজ। তবে যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয়-ভীতি আছে তাদের পক্ষে মোটেও কঠিন নয়। -সূরা বাকারা, আয়াত : ৪৫
চাবি ছাড়া যেমন তালা খোলা অসম্ভব তেমনিভাবে নামাজ ছাড়া বেহেশতে প্রবেশ করাও অসম্ভব ব্যাপার।
বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مِفْتَاحُ الْجَنَّةِ الصَّلٰوةُ.
অর্থ : নামাজ বেহেশতের চাবি। -মুসনাদে আহমাদ
আর কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম নামাজের হিসোব হবে। যেমন ইরশাদ হচ্ছে-
اَوَّلُ مَا يُحٰسَبُ بِهِ الْعَبْدُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الصَّلٰوةُ.
অর্থ : কেয়ামাতের দিবসে সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব নেওয়া হবে। -তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
جُعِلَتْ قُرَّةُ عَيْنِىْ فِىْ الصَّلٰوةِ ـ
অর্থ : নামাজ আমার চোখের শীতলতা। -নাসায়ী শরীফ
এখানেই শেষ নয়, নামাজের ফযিলত সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি ঠিকমতো নামাজ আদায় করে, তার সমস্ত গোনাহ মাফ হয়ে যায়। জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে যায়। জাহান্নাম তার জন্য হারাম হয়ে যায়। তিনি আরো বলেন, নিয়মিত নামাজ আদায়কারীকে আল্লাহ তাআলা পাঁচটি পুরস্কার দান করবেন।
এক. রিজিকের অভাব দূর করে দিবেন।
দুই. কবরের আযাব মাফ করে দিবেন।
তিন. আমলনামা ডান হাতে দিবেন।
চারহ. পুলসিরাত বিদ্যুতের গতিতে পার করে দিবেন।
পাঁচ. বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
আল্লামা ইকবাল বলেন-
یہ ایک سجدہ جسے گراں سمجھتا ہے ٭ ہزار سجدہ سے دیتا آدمی کو نجات
অর্থ : এই একটি সেজদা যাকে তুমি কঠিন মনে করছ হাজার সেজদা থেকে মানুষকে নাজাত দেয়।
জনৈক ফার্সী কবি নামাজের ব্যাপারে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন-
مکن سستی درنماز پنجگا نہ ٭ فویل المصلین الذین
অর্থ : পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে উদাসীনতা ও অবহেলা প্রদর্শন করো না, কেননা ঐসব নামাজীদের ধ্বংস অনিবার্য, যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে গাফেল।
এমনিভাবে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত বর্ণনা করেও নামাজের গুরুত্ব ও ফযিলত সম্পর্কে বলে শেষ করা যাবে না। তাই পরিশেষে আমি বলতে চাই, আসুন, আমরা নামাজ সম্পর্কে আরো জ্ঞান অর্জন করি এবং সে মতে মেহনত করে নামাজের প্রতি পূর্ণ যত্নবান হই এবং যারা সমস্ত মানুষ নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে জানে না তাদের বুঝিয়ে নামাজের দিকে আনার চেষ্টা করি। তাহলেই সম্ভব হবে এই নির্যাতিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত, অধঃপতিত, অবহেলিত, মুসলিম মিল্লাতকে পুর্নজ্জীবিত করা। তাহলেই সমাজ ফিরে আসবে শান্তি-শৃঙ্খলা, সাম্য-মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ববোধ, সৌহার্দ-সম্প্রীতি। ফিরে আসবে সাহাবায়ে কেরাম রাযি.-এর যুগের মতো সোনালি যুগ। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি হবে অর্জিত।
পরিশেষে কবি নজরুল ইসলামের কবিতার মাধ্যমে আমার বক্তৃতার  ইতি টানছি-
ঘুমাইয়া কাযা করেছি ফজর
তখনও জাগিনি যখন জোহর।
হেলায় খেলায় কেটেছে আসর
মাগরিবের ঐ শুনি আযান।
এখনও জামাতে আছে স্থান।
আমাদের সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন।
সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube চ্যানেল Rahe Sunnat Media

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button