বক্তা, ওয়ায়েজ ও আলোচক হওয়ার কৌশল।

বক্তা, ওয়ায়েজ ও আলোচক হওয়ার কৌশল।

বক্তা, ওয়ায়েজ ও আলোচক হওয়ার কৌশল।

বক্তৃতার প্রভাব

সব মানুষই বক্তৃতা করে না, আবার সবাই বক্তৃতা জানেও না। তাই বক্তৃতা মানব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা সবাই জানি, সমাজের কিছু লোক বক্তৃতা করেন, বাকিরা বক্তৃতা শোনেন। শ্রোতার তুলনায় বক্তার সংখ্যাই কম। অনেক বক্তা এমন আছেন যিনি বক্তৃতা শুরু করলে মানুষ নীরব হয়ে শোনে। বহু দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ তাদের বক্তৃতা শোনার জন্য সমবেত হয়।
আবার কারো কারো বক্তৃতা অনলবর্ষী, তাদের বক্তৃতায় শ্রোতারা প্রভাবিত ও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। কারো বক্তৃতা উদ্দীপনাময়, তাদের বক্তৃতায় শ্রোতারা উচ্ছ্বসিত ও উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। কারো বক্তৃতা মর্মস্পর্শী, তার বক্তৃতা শ্রোতারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। এমনকি অশ্রুও ঝরায়। কারো বক্তৃতা শাণিত, যুক্তি ধারালো অস্ত্রের মতো। তাতে শ্রোতাদেরও বুদ্ধি বিবেক জাগ্রত হয়ে ওঠে, চিন্তার রাজ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আবার কিছু বক্তা শিল্প সৌন্দর্যে, কেউবা রস-মাধুর্যে, কেউবা মনোহারী চাতুর্যে শ্রোতাদের আকৃষ্ট করেন, এভাবে বক্তারা শ্রোতাদের প্রভাবিত করেন।
বক্তৃতা কোনো বিষয়ে লোক সমাজকে অবহিত ও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে, স্বমতে নিয়ে আসে। কিংবা কারো বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে অথবা কারো প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা জাগিয়ে তোলে। কিংবা উদ্দীপ্ত করে কোনো উত্তম কাজে। ভালো বাগ্মীদের সভা ভক্তে ভরে ওঠে। আপনার অবস্থান কি? আপনি কি বক্তা? না শুধুই শ্রোতা।

আপনি কেন বক্তৃতা শিখবেন?

আপনি কি বক্তৃতা করেন? না করে থাকলে আপনিও বক্তৃতা করুন। আপনি কেন সব সময় শ্রোতা থাকবেন? আপনার কি কোনো আদর্শ নেই? আপনার জীবনের কোনো মিশন নেই কি? আপনি কি চান না মানুষের মধ্যে উন্নতমানের দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনা সৃষ্টি হোক। মানুষ আপনার পছন্দের জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করুক? মানুষ আপনার দল বা আপনার পছন্দের দলকে সমর্থন করুক, তা কি আপনার কাম্য নয়?
আপনি কি চান না সমাজ থেকে অন্যায়, অনাচার, সন্ত্রাস, দুর্নীতি এবং যাবতীয় অশান্তি ও দুষ্কৃতি দূর হোক? আপনি কি চান না সমাজে সত্য, ন্যায়, সততা, সেবা ও যাবতীয় কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত হোক? আপনি কি চান না মানুষ সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হোক এবং অসত্য ও মন্দের বিরুদ্ধে হোক বিক্ষুব্ধ?
এসব ব্যাপারে আপনি কি আপনার কোনো দায়িত্ব আছে বলে মনে করেন না? যদি এসব ব্যাপারে আপনার জবাব ইতিবাচক হয়, তবে অবশ্যই আপনি বক্তৃতা করুন। কারণ-
১. দীন প্রচারের একটি বিশেষ মাধ্যম হচ্ছে বক্তৃতা, বক্তৃতাতে আছে মানুষের মনকে আকর্ষণ করার বিশেষ শক্তি।
২. বক্তৃতা আদর্শ প্রচারের বলিষ্ঠ হাতিয়ার।
৩. বক্তৃতা শ্রোতার বিবেকে নাড়া দেয়। তাকে সচেতন করে তোলে।
৪. বক্তৃতা জ্ঞান দান করে, বুঝ সৃষ্টি করে।
৫. বক্তৃতা শ্রোতার ভুল ধারণা দূর করে দেয়।
৬. বক্তৃতা শ্রোতার মনে ভক্তি ও ভালোবাসা সৃষ্টি করে।
৭. বক্তৃতা শ্রোতাদের নিজ মতে বা আদর্শে আনার একটি বিরাট শক্তি।
৮. বক্তৃতা শ্রোতাদের মতামত সৃষ্টি করে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের শক্তি যোগায়।
৯. বক্তৃতা শ্রোতার সমর্থন যোগায়।
১০. বক্তৃতা উৎসাহিত করে।
১১. বক্তৃতা শ্রোতাদের আবেগাপ্লুত করে।
১২. বক্তৃতা শ্রোতাদের উদ্বুদ্ধ ও উদ্বেলিত করে।
১৩. বক্তৃতা বক্তার জনপ্রিয়তা সৃষ্টি করে।
১৪. বক্তৃতা বক্তার ব্যক্তিত্ব তৈরি করে।
১৫. বক্তৃতা ঐকমত্যে আনার এবং ঐক্যবদ্ধ করার মোক্ষম হাতিয়ার।
১৬. বক্তৃতা মানুষকে কাজে লাগানোর সুনিপুণ কৌশল।
১৭. বক্তৃতা হৃদয়ের উপর প্রভাব সৃষ্টি করে।
১৮. বক্তৃতা শ্রেষ্ঠ যোগাযোগ প্রক্রিয়া, বাস্তব গণমাধ্যম।
১৯. বক্তৃতা আদর্শ সমাজ গড়ার মাধ্যম।
২০. বক্তৃতায় আছে অদ্ভুত আকর্ষণ শক্তি।
২১. বক্তৃতা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতাযুদ্ধে জয় লাভ করার শাণিত অস্ত্র। তাই আমরা সকলেই বক্তৃতার দ্বারা নিজ জীবনের উদ্দেশ্য সফল করি।

বক্তৃতা কি?
বক্তৃতা একটি শক্তিশালী কৌশল। বক্তৃতা একটি আর্ট। বক্তৃতা অর্থ হচ্ছে বলা, যা ব্যক্ত করা হয়। মূলত বক্তৃতা হলো সমবেত জনম-লীর সম্মুখে বা অডিও, কিংবা অডিও ভিজুয়্যাল, অথবা ইন্টারনেট প্রচার ও যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে বিশেষ উদ্দেশে, বিশেষ বিষয়ে এবং বিশেষ জনম-লীকে লক্ষ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিশেষ ভঙ্গিতে উপস্থাপিত সুবিন্যস্ত উক্তি, যার অপর নাম বক্তব্য ও আলোচনা।
বক্তৃতা যে কত রকম, কত বিচিত্র তার ধরন-প্রকৃতি সে হিসাব করা বড় কঠিন। আমাদের দেশ এবং তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই বক্তৃতার বৈচিত্র্য ব্যাকরণ বিচারে বর্ণনা করা প্রায় অসাধ্য। তবে কতিপয় প্রকার-প্রকরণ তো প্রথায় পরিণত হয়েছে। উদ্দেশ্য আয়োজন ও কাঠামোগত দিক থেকে বক্তৃতার ধরন বৈচিত্র্য নিম্নরূপ-
১. জনসভা বা সমাবেশে নেতা কর্মীদের উদ্দেশে বক্তৃতা।
২. অডিও বা অডিও ভিজুয়্যাল যোগাযোগ মাধ্যমে বক্তৃতা।
৩. পার্লামেন্ট সদস্যদের বক্তৃতা।
৪. দলীয় কর্মী সভায় বক্তৃতা।
৫. দলীয় পরামর্শে ও নির্বাহী পরিষদের সভায় বক্তৃতা।
৬. অধঃস্তন নির্বাহী কর্মচারীদের উদ্দেশে বক্তৃতা।
৭. উপ-কমিটিতে সুপারিশ তৈরির উদ্দেশে বক্তৃতা।
৮. মতামত কিংবা আদর্শ প্রচারের উদ্দেশে সুধী সমাবেশে বক্তৃতা।
৯. সেমিনারে বক্তৃতা।
১০. সিম্পোজিয়াম বা আলোচনা সভার বক্তৃতা।
১১. বিতর্ক অনুষ্ঠানের বক্তৃতা।
১২. টেলি কনফারেন্স বা সিন্ডিকেট বক্তৃতা।
১৩. ছাত্রদের উদ্দেশে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের বক্তৃতা।
১৪. প্রশিক্ষণের উদ্দেশে শ্রেণিকক্ষে প্রশিক্ষকের বক্তৃতা।
১৫. ধর্মীয়গ্রন্থের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে দেয়া বক্তৃতা।
১৬. বিশেষ উদ্দেশে জনতাকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বক্তৃতা।
১৭. উত্তেজিত বিশৃঙ্খল জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বক্তৃতা।
১৮. শান্তি স্থাপন এবং উন্নয়ন ও সেবা কাজে উদ্বুদ্ধ করণমূলক বক্তৃতা।
১৯. পণ্য বিক্রয়ের উদ্দেশে ক্যানভাসারের বক্তৃতা।
২০. প্রশিক্ষণমূলক সাপ্তাহিক বক্তৃতা।
২১. প্রশিক্ষণমূলক মাসিক বক্তৃতা।
২২. প্রতিযোগিতামূলক বক্তৃতা।
২৩. সম্মিলিত বক্তৃতা।
২৪. কোনো অনুষ্ঠানের সমাপনী বক্তৃতা।
আমাদের দেশে শ্রেণি ক্ষেত্র ও পরিবেশ ভেদে উপরিউক্ত ধরনের বক্তৃতাসমূহ চালু রয়েছে। নিজ নিজ অবস্থানে প্রত্যেক প্রকার বক্তৃতারই রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব।
উপরে বক্তৃতার যেসব প্রকার-প্রকরণের কথা আলোচনা করা হলো, এর মধ্যে আপনি কোন প্রকারের বক্তা?
এত প্রকারের মধ্যে আপনি শুধু এক প্রকারের বক্তা। নাকি সর্বপ্রকার বক্তা? তবে আপনার প্রকার যাই হোক, আপনি দক্ষ প্রভাব বিস্তারকারী ও জনপ্রিয় বক্তা হোন। এজন্য কৌশল আয়ত্ত করুন। সময় ও প্রস্তুতির দিক থেকে আপনাকে দুই ধরনের বক্তৃতা করতে হতে পারে।
১. পূর্ব নির্ধারিত বক্তৃতা
২. উপস্থিত বক্তৃতা।
পূর্ব নির্ধারিত বক্তৃতার ক্ষেত্রে তো আপনি প্রস্তুতি নেবার সুযোগ পাবেন। কিন্তু উপস্থিত বক্তৃতার ক্ষেত্রে সে সুযোগ পাওয়া যায় না। আপনি হঠাৎ বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আদিষ্ট। তখন আপনাকে উপস্থিতভাবেই বক্তৃতা করতে হবে। তাই বক্তৃতার নিয়ম ও কৌশলগুলো আপনার আয়ত্তে থাকা বাঞ্ছনীয়।

উপস্থিত বক্তৃতার পূর্ব প্রস্তুতি
যদি উপস্থিত ক্ষেত্রে আপনাকে বক্তৃতা করতে বলা হয়, তবু বক্তৃতা করতে পিছপা হবেন না। আপনি রাজি হয়ে যাবেন। এক্ষেত্রে আপনি একটি সফল সুন্দর বক্তৃতা করতে পারেন, তাহলে আপনার ব্যক্তিত্বের প্রভাব এবং জনপ্রিয়তা দারুণভাবে বেড়ে যাবে। উপস্থিত বক্তৃতার পূর্বে আপনি যতটুকু সময় পান, মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নিন। সাথে সাথে নিম্নোক্ত কাজগুলো করুন-
১. নিজের মজবুত আস্থা, সাহস ও আত্মিক বল প্রয়োগ করুন।
২. বিষয়টির আদ্যোপান্ত সংক্ষেপে ভেবে নিন।
৩. চিন্তা করে নিন আপনি এ বক্তৃতার মাধ্যমে কি উদ্দেশ্য হাসিল
করতে চান?
৪. বিষয়ের প্রধান প্রধান পয়েন্টগুলো মনে মনে বিন্যস্ত করুন।
৫. কোনো বিশেষ পয়েন্ট যুক্তি, ভাষা, ভঙ্গি, উপমা পেশ করে আপনি অন্যদের ছাড়িয়ে গিয়ে অনন্যতা লাভ করতে পারবেন এরূপ মনোবল নিয়ে বক্তৃতা শুরু করুন। এভাবে উপস্থিত বক্তৃতা করে আপনি কামিয়াব হতে পারেন। আপনি চমকে দিতে পারেন দর্শক এবং শ্রোতাদের। আপনার আরজ ও উদ্দেশ্য কার্যকরভাবে ছড়িয়ে দিতে পারেন জনগণের মাঝে। আমার মনে পড়ে বায়তুল মুকাররমের উত্তর গেটে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম শিখা-চিরন্তনের বিপক্ষে বক্তৃতা দিয়ে শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন; জনতার হৃদয়ে আগুন জ্বালিয়ে ছিলেন। অন্য সকলের মতো তাঁর বক্তৃতার কথা এখনও আমার হৃদয়ে রোখাপাত করে আছে।

নির্ধারিত বক্তৃতার পূর্ব প্রস্তুতি
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বক্তৃতার বিষয় সম্পর্কে বক্তা আগে থেকেই অবগত থাকেন। বক্তৃতার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, বিষয় এবং এর সাথে সম্পৃক্ত সবকিছু সময়ের পূর্বেই সুনির্দিষ্ট হয়। যখন এরকম নির্ধারিত বক্তৃতা দেয়া হয়, তখন পূর্ব হতেই প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। যেমন ধরুন, আপনার বক্তৃতার বিষয় ইলমে দীনের গুরুত্ব ও ফযিলত, তখন আপনি হযরত মাওলানা আহমদ আলী লাহোরী রহ. কৃত আল-কুরআনের বিষয়ভিত্তিক সূচিপত্র দেখুন। এটি না পাওয়া গেলে আল-কুরআনের বিষয়ভিত্তিক আয়াত হাফেজ মাওলানা শহীদুল ইসলামের কিতাবটি দেখুন। গভীরভাবে মুতায়ালা করুন। ইলমে দীনের গুরুত্ব ও ফযিলত সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের কোন কোন সূরায় কী কী কথা বলা হয়েছে, তার মধ্য হতে আপনার পছন্দমত দু’চারটি আয়াত লিখে নিন। অতঃপর বিস্তারিত সম্ভব না হলে তাফসীরে শাইখুল হিন্দ, বয়ানুল কুরআন বা মাআরিফুল কুরআনের কোনো একটি খুলে আয়াতগুলো বের করুন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অনুধাবন করার চেষ্টা করুন ও আকর্ষণীয়, চুম্বক অংশগুলো খাতায় নোট করুন।
অতঃপর মেশকাত শরীফ, রিয়াযুস সালেহীন, ফয়যুল কালাম, মা‘আরিফুল হাদীস বা হাদীসের কিতাবসমূহের মাঝে সহজলভ্য একটি হাদীসের কিতাব খুলে মুতায়ালা করুন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীগুলো লিপিবদ্ধ করুন। অবশ্য আয়াত ও তাফসীরের ক্ষেত্রে তাফসীরে দুররে মানসূর ও ইবনে কাসীরের সহযোগিতা নিলে নির্ধারিত একটি হাদীসের অংশ আপনার চোখের সামনে চলে আসবে। এখন আপনার কাছে তথ্যের একটি সমাহার দেখবেন।

তাই একটি চমকপ্রদ বক্তৃতা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিন। নিম্নে প্রস্তুতির কয়েকটি টিপস তুলে ধরা হলো-
১. সর্বপ্রথম কাজ হবে রুজু ইলাল্লাহ। প্রার্থনা করুন, হে আল্লাহ! ইখলাসের সাথে, আপনার রেজা মোতাবেক ও সুন্নত অনুযায়ী এমন কিছু কথা বলার তাওফীক দান করুন, যাতে আপনার দীনের ও বান্দাদের উপকার হয়।
২. বক্তৃতার বিষয় শ্রোতা, পরিবেশ ও বক্তৃতার গুরুত্ব ভালোভাবে চিন্তা করে নিন।
৩. এ বক্তৃতার মাধ্যমে আপনি শ্রোতাদের কোন লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান এবং কী ধারণা দিতে চান? তা ভালোভাবে উপলব্ধি করুন।
৪. পড়ালেখা করতে হবে, প্রয়োজনীয় তথ্য, রেফারেন্স ও দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করতে হবে।
৫. গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো নোট করতে হবে। লিখিত বক্তব্য পেশ করতে হলে বক্তৃতার খসড়া তৈরি করতে হবে। ঘরে বসে পরীক্ষামূলক বক্তৃতা দিতে হবে। এভাবে মজবুত মানসিক দৃঢ়তা, প্রবল ইচ্ছা শক্তি, পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি এবং চমৎকার আয়োজন নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ও প্রফুল্ল মনে মঞ্চে উঠতে হবে। আপনার উপস্থিতি অনুপম ও আকর্ষণীয় করতে হবে।
৬. আপনার বক্তৃতা সুন্দর হোক ও লোকেরা আপনার প্রশংসা করুক এ মনোভাব না নিয়ে লোকেরা আপনার বক্তৃতা বুঝুক এ মনোভাব নিয়ে বক্তৃতা করলে আপনার বক্তৃতা অত্যন্ত সুন্দর ও গ্রহণীয় হবে।

কর্ষণীয় উপস্থিতি
বক্তৃতার সুন্দর উপস্থিতির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং-
১. ঠিক সময় উপস্থিত হতে হবে।
২. সমাবেশ বা আলোচনা সভায় শুরুতে উপস্থিত হতে না পারলেও ঠিক কখন এবং কয়টায় উপস্থিত হবেন, তা পূর্বেই সভাকে অবহিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। আপনার উপস্থিতির বিষয়ে আয়োজক এবং দর্শকদের নিশ্চিত করতে হবে।
৩. সভাকক্ষে কিংবা মঞ্চে আগমনকালে যদি অপর কেউ বক্তৃতারত না থাকে, তাহলে উপস্থিত শ্রোতা-দর্শকদের সাথে সালাম বিনিময় করতে পারেন। হাসি মুখে প্রবেশ করতে হবে। হাত নেড়ে তাদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করা যেতে হবে।
৪. পরিবেশ ও সময় থাকলে তাদের বলুন, আপনারা ভালো আছেন তো?
৫. সুযোগ ও অবকাশ থাকলে মঞ্চে উপবিষ্ট অন্যদের সাথে মুসাফাহা করতে হবে এবং ফাঁকা থাকলে মু‘আনাকা করে কুশল বিনিময় করতে পারেন।
৬. এবার নির্ধারিত আসন গ্রহণ করতে হবে। এমন আসন গ্রহণ করা যাবে না, যা পরিবর্তনের সম্ভবনা আছে।
৭. বসার পর কিছুক্ষণ হাস্যোজ্জ্বল ও প্রফুল্ল থাকুন।

চমৎকার উপস্থাপন
১. এই মাত্র আপনাকে বক্তৃতা রাখার অনুরোধ করা হলো। আপনি মনে মনে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করে নিন ও মৃদু হাসি দিয়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসুন। লক্ষ করে দেখবেন, আপনার মুচকি হাসি ও প্রফুল্লতা শ্রোতা-দর্শকদের আনন্দিত করবে। আপনার বক্তব্যের দিকে অত্যধিক মনোনিবেশ করবে।
২. দাঁড়িয়েই কয়েক মুহূর্তের মধ্যে শ্রোতাদের অবস্থা দেখে অবস্থা ভেদে আপনার চেহারার রূপ পরিবর্তন হবে। পূর্বে সালাম বিনিময় না হয়ে থাকলে সকলকে লক্ষ করে সালাম করতে হবে।
৩. এভাবে ৪/৫ সেকেন্ডের মধ্যে শ্রোতা-দর্শকদের মানসিক সংযোগ স্থাপন করে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে (যদি পরিচয় জানা না থাকে) স্বাভাবিকভাবে বক্তব্য শুরু করতে হবে। শুরুতেই চিৎকার করা যাবে না।
৪. কর্কশ কণ্ঠস্বর পরিহার করে মিষ্টি মধুর আওয়াজে কথা বলতে হবে।
৫. কষ্ঠস্বরকে শ্রোতাদের উপযোগী করে কথা বলতে হবে।
৬. ভাষার শুদ্ধতার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। সাধু ও চলিতের সংমিশ্রণ করা যাবে না। আঞ্চলিকতা পরিহার করতে হবে। শব্দ উচ্চারণ করতে হবে সঠিকভাবে। শব্দ চয়ন, বাক্যের বিন্যাস এবং উচ্চারণের উপরই আকর্ষণীয় উপস্থাপনের অনেক কিছু নির্ভর করে।
৭. বক্তব্য অবশ্যই স্পষ্ট ও সাবলীল হতে হবে। জড়তা পরিহার করতে হবে। নতুন বক্তা হলে ভয়ের কারণে বাম হাত শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করে বক্তৃতা শুরু করলে সব ভীতি দূর হয়ে যাবে। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো রিপিট করতে হবে।
৮. বক্তৃতার মধ্যে চুটকি, খ-গল্প বা কবিতার কিংবা কোনো পরিচিত ক্ষুদ্র ঘটনা বলে পুরো মাজমাকে (অনুষ্ঠানকে) রসালো করে রাখতে হবে।
৯. এমনভাবে বক্তব্য রাখতে হবে যাতে শ্রোতারা বুঝতে পারে আপনি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখছেন।
১০. খুবই আন্তরিকতার সাথে দিল থেকে কথাগুলো বলতে হবে। কেননা আল্লামা ইকবাল রহ. জওয়াবে শিকওয়ায় বলেছেন-
دل سے جو بات نکلتی ہے اثر رکھتی ہے * پر نہیں مگر طاقت پرواز رکھتی ہے
অর্থ : যে কথা অন্তর থেকে নির্গত হয় তা অবশ্যই প্রভাব সৃষ্টি করে। পাখা নেই কিন্তু উড়তে পারে।
اِذَا تَكَرَّرَ الْكَلَامُ عَلَى السَّمْعِ تَقَرَّرَ فِىْ الْقَلْبِ যে কথা বারবার আলোচিত হয় তা হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়ে যায়।
পুরো বক্তব্যের সময়কে আন্তরিকতা ও খোশমেজাজ দিয়ে মাতিয়ে রাখতে হবে। এমনভাবে সম্মোহিত করে রাখতে হবে যেন বক্তৃতা সুন্দর, চমৎকার, হৃদয়গ্রাহী হয় এবং স্মৃতিতে অমøান করে রাখা যায়।
১১. সাজিয়ে-গুছিয়ে বক্তব্য রাখা। কিছু বক্তা এমন রয়েছে, যাদের বক্তব্যের আগা-মাথা নেই। তাদের বক্তৃতার বিষয়বস্তু কি? শুরু কোথায়? শেষ কোথায়? শ্রোতারা বুঝতে পারে না যে, সে কি বিষয়ে বলতে চায়; এমনটি করা যাবে না। সুবিন্যস্ত করে বলতে হবে।
এভাবে পেশ করতে হবে-
১২. বিশেষত ক. সম্বোধন। খ. মূল বক্তব্য। গ. উপসংহার ঘ. আবেদনপূর্ণ ও আকর্ষণীয় সূচনা, প্রভাবশালী কথা। ঙ. নিজস্ব মন্তব্য ও মতামত। চ. অবিচ্ছিন্ন শব্দময়-গতিশীল উপস্থাপনা। ছ. অনুপম উপসংহার এবং কাব্যরসে সমৃদ্ধ বক্তৃতার মাধ্যমেই একজন শ্রেষ্ঠ বক্তা হওয়া যেতে পারে।
১৩. আপনার সময় শেষ হওয়ার পর বক্তব্য লম্বা করা যাবে না। এতে শ্রোতাদের শোনার আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়।
১৪. বক্তৃতা দেয়ার সময় কারো কথা নকল করতে হলে বিশুদ্ধভাবে নকল করতে হবে।
১৫. শ্রোতাদেরকে সম্বোধন করে কিছু করার আহ্বান জানালে নিজেকে
অন্তর্ভুক্ত করে তা বলতে হবে। যেমন : আপনারা নামাজ পড়বেন, এভাবে না বলে বরং এভাবে বলতে হবে, আসুন আজ হতে আমরা সকলে রীতিমতো নামাজ পড়ি।
১৬. প্রতিটি বক্তৃতার ভিত্তি হবে পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ। অর্থাৎ, কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে উপস্থাপন করা।
১৭. যখন যে বিষয়ে কোনো বক্তব্য রাখতে হবে তার পূর্বে বিষয়টির উপর মুতালা‘আ করতে হবে। জাতিকে কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান দান করতে হবে, এ আঙ্গিকে মুতালা‘আ করতে হবে।
১৮. বক্তাদের নিজস্ব কুতুবখানা থাকতে হবে।
১৯. প্রতিটি বক্তৃতা হবে জ্ঞান ও তথ্যনির্ভর এবং الموعظة الحسنة এর আঙ্গিকে। আক্রমণ করা, আঘাত হানা, সমালোচনা জাতীয় বক্তব্য যাতে না হয় এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। এতে কর্তৃপক্ষও বিব্রতবোধ করে।

লেবাস ও অঙ্গভঙ্গি
বক্তৃতায় স্থান, কাল, পাত্র ও সময়ের ভিত্তিতে লেবাস পরিধান করতে হবে। হ্যাঁ মুসলমান হিসাবে তা হবে অবশ্যই শরীয়তসম্মত। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করতে হবে। জামার বোতাম খোলা রাখা যাবে না। কলার ঠিক রাখতে হবে। বক্তৃতার সময় এমনভাবে হাত নাড়াচাড়া করা যাবে না, যা দৃষ্টিকটু। কেউ কেউ প্রত্যেক কথায় হাত নাড়াতে থাকে এটি সঠিক নয়। স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে হবে। প্রয়োজনে হাত ব্যবহার করতে হবে শালীন ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে।
জামার হাত গুটানো যাবে না। মাথা নাচানো যাবে না। শান্তভাবে ধীর ভঙ্গিতে মার্জিত বক্তব্য রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, লেবাস ও অঙ্গভঙ্গি মার্জিত ও রুচিসম্মত হতে হবে। সব সময়ই আত্মমর্যাদাবোধের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। বেশি চাকচিক্যময় ও শরীয়তের খেলাফ পোশাক পরা যাবে না।

সময়ের প্রতি দৃষ্টি
বক্তৃতা করতে উঠলে অনেকেরই সময়ের প্রতি লক্ষ থাকে না। এমনটি করা যাবে না। এতে প্রতিযোগিতামূলক বক্তৃতা অনুষ্ঠান হলে নম্বর কাটা যেতে পারে। তাই আপনি আপনার জন্য নির্ধারিত সময়ে বিষয়বস্তু ঠিক রেখে বক্তৃতা সাজিয়ে-গুছিয়ে শেষ করতে হবে। এ জন্য মনে রাখতে হবে,
১. বক্তৃতা নিজ আয়ত্তের মধ্যে রাখতে হবে।
২. বক্তৃতার প্রত্যেক অংশের জন্য নির্ধারিত সময়টুকুই কাজে লাগাতে হবে।
৩. নির্ধারিত সময়ের বেশি বক্তব্য দেয়াকে অন্যায় মনে করতে হবে।
৪. অতিরিক্ত সময় নিয়ে অন্যদের বিরক্তির কারণ হওয়া যাবে না।
৫. সময় নিয়ন্ত্রণে থাকলে শ্রোতারা পুনঃপুন আপনার বক্তৃতা শোনার আগ্রহ প্রকাশ করবে।

বর্জনীয় কিছু জিনিস
১. অতিরিক্ত ভাবগম্ভীর, ভ্যাবাচেকা কিংবা এলোমেলোভাবে মঞ্চে ওঠা।
২. দৃষ্টিকটু অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন।
৩. বাঁকা হয়ে দাঁড়ানো।
৪. প্রয়োজনের তুলনায় নিম্নস্বরে বা উচ্চৈঃস্বরে বক্তৃতা করা।
৫. প্রতিপক্ষকে গালমন্দ করা, কটাক্ষ করা।
৬. নেতিবাচক বক্তৃতা করা।
৭. আঞ্চলিকতা, অশুদ্ধ ভাষা, কঠিন ভাষা ব্যবহার করা।
৮. জড়তা, উত্তেজনা, বিষণ্যতা।
৯. একই কথা বারবার বলা।
১০. আমি প্রস্তুতি নেয়ার সময় পাইনি, আমাকে বক্তৃতার কথা আগে জানানো হয়নি, আমার কিছু জানা নেই—এ জাতীয় কথা বলা।
১১. নির্ধারিত সময়ের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা।
১২. মিথ্যা ওয়াদা করা।
১৩. ভিত্তিহীন কথা বলা।
১৪. অবাস্তব ও ছন্দবিহীন কথা বলা।
১৫. দুর্লভ ও দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করা।

আমাদের সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন।
সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube চ্যানেল Rahe Sunnat Media

 

Exit mobile version