ইবাদতযাকাত

যাকাতের গুরুত্ব ও ফযীলত। আবু তাসনীম উমাইর

যাকাতের গুরুত্ব ও ফযীলত। আবু তাসনীম উমাইর

যাকাতের গুরুত্ব ও ফযীলত। আবু তাসনীম উমাইর

সহজে বুঝার জন্য আমার আলোচনাকে আমি চারটি ভাগে ভাগ করছি।
১. যাকাত কী ও কেন, ২. যাকাতের গুরুত্ব,
৩. যাকাতের ফযিলত, ৪. আমাদের করণীয়।

যাকাতের শাব্দিক অর্থ পবিত্র করা বা বর্ধিত হওয়া। আর শরীয়তের পরিভাষায় যাকাত বলা হয়, সম্পদের এমন অংশকে যা শরীয়তের নির্দেশানুক্রমে সম্পদ থেকে গ্রহণ করা এবং শরীয়ত মোতাবেক খরচ করা।
আমরা সকলেই জানি তাওহীদ, রিসালাত এবং সালাত কায়েমের পরেই যাকাত ইসলামের তৃতীয় রুকন। পবিত্র কুরআনে সত্তরেরও অধিক স্থানে সালাত কায়েমের সাথে সাথে যাকাত আদায়ের কথা এমনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী শরীয়ত এ দু’টির গুরুত্ব, মর্যাদা ও স্থান প্রায় এক। ঠিক এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর কয়েকটি অঞ্চলের লোক যারা প্রকাশ্যভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিল, আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমানের সাক্ষ্য দিত। সালাত আদায় করত, কিন্তু যাকাত দিতে অস্বীকার করল। খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচলনা করেন। তিনি এই মূল তত্ত্বের ভিত্তিতে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন, সালাত ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা, মূলত আল্লাহ ও রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীন থেকে বের হয়ে যাওয়ারই শামিল। বুখারী ও মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় আছে, হযরত আবু বকর রাযি. হযরত উমর রাযি.-কে এই বলে উত্তর দিয়েছিলেন-

وَاللهِ لَاُقَاتِلَنَّ مَنْ فَرَّقَ بَيْنَ الصَّلوٰةِ وَ الزَّكوٰةِ.

অর্থ : আল্লাহর কসম! যারা সালাত ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করবে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই যুদ্ধ করব।
-মা‘আরিফুল হাদীস : ৪র্থ খ-, যাকাত অধ্যায়
অতঃপর সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম খলিফার এ সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পারলেন, তাঁর মতামত গ্রহণ করলেন এবং এর ওপরই ইজমা হয়ে গেল।

ওপরের আলোচনা দ্বারা আমরা পরিষ্কার ভাষায় বুঝতে পেরেছি, যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা জানি, ইসলামী অর্থনীতির মূল বিষয়টি হলো যাকাত। একমাত্র যাকাতের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। তাই তো পবিত্র কুরআনে আলোচিত বনী মুস্তালাক গোত্রের যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতির ভুল সংবাদ পেয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করতে সামান্য বিলম্বও করেননি। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রাযি.-কে ইয়ামানের গভর্নর হিসাবে প্রেরণের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে যাকাত গ্রহণের উপদেশ দান করেছেন। এছাড়াও ঘোষিত হয়েছে- اَلزَّكوٰةُ قَنْطَرَةُ الاِسْلَامِ যাকাত ইসলামের সেতু।

আপন অঢেল সম্পদের মধ্যেই প্রকৃত শান্তির অনুসন্ধানী মানব-সমাজ একমাত্র যাকাত প্রদানে অবহেলা হেতু আজ অধঃপতনের স্বীকার হচ্ছে। পার্থিব জীবনে নেমে আসছে চরম অশান্তি আর নিজেকে ঠেলে দিচ্ছে পরকালের ভয়াবহ পরিণতির দিকে।
তাইতো যাকাত অস্বীকারকারীকে ইসলাম কাফেররূপে গণ্য করেছে। যাকাত আদায় না করায় এক শ্রেণির লোকের শাস্তির উল্লেখ করে ইরশাদ করেছেন-

حَتّٰى يُقْضٰى بَيْنَ الْعِبَادِ فَيَرٰى سَبَيْلَهُ اِمَّا اِلٰى الْجَنَّةِ وَاِمَّا اِلٰى النَّارِ ـ

অর্থা : অবশেষে বান্দাদের মাঝে ফায়সালা হবে। অতঃপর তার পথ জান্নাত বা জাহান্নাম। -মুসলিম শরীফ, মা‘আরিফুল হাদীস : ৪/১৩৩

এবার আসুন যাকাতের ফযিলত ও শাস্তি সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। যে জিনিস যত গুরুত্বপূর্ণ তার ফযিলত তত বেশি, শাস্তিও তত কঠিন। ইরশাদ হচ্ছে-

وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ

অর্থ : এবং যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জিভূত করে এবং তারা সম্পদকে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে না। হে নবী! আপনি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির দুসংবাদ দিন। -সূরা তাওবাহ, আয়াত : ৩৪
আর এ কথা সর্বজন স্বীকৃত, সম্পদের শুকরিয়া হলো যাকাত। আর তাই তো পবিত্র কুরআন গুটিসংখ্যক গুণাবলির পাশাপাশি যাকাত প্রদানকারী প্রকৃত সফলকাম আখ্যা দেওয়া হয়েছে-

وَالَّذِيْنَ هُمْ لِلزَّكوٰة فَاعِلُوْنَ ـ

অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে-

خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَ تُزَكِّيْهِمْ بِهَا ـ

অর্থ : হে নবী! আপনি তাদের সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ করুন। -সূরা তাওবাহ, আয়াত : ১০৩
আর যাকাতের এই বিশেষ ফযিলতের কারণেই যখন জনৈক সাহাবীর নিকট যাকাত চাওয়া হলো তখন একটি উটের বাচ্চা ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও প্রদান করেছিলেন বিশাল আকারের উট।

যাকাত আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের একটি বিশেষ মাধ্যম। যথাযথভাবে যাকাত প্রদানেই সম্পদকে করে তোলে প্রকৃত শান্তির মাধ্যম। তাই তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ ঘোষণা করেন-

اَنْفِقْ يَا اِبْنِ اٰدَمَ يُنْفَقْ عَلَيْكَ ـ

অর্থ : হে বনী আদম! তুমি ব্যয় করো, তোমার ওপর ব্যয় করা হবে। -বুখারী ও মুসলিম
যাকাতের এ অবিশ্বাস্য ফযিলতের কারণে মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

يَمْحَقُ اللهُ الرِّبٰى وَ يُرْبِىْ الصَّدَقَاتِ ـ

অর্থ : আল্লাহ তাআলা সুদকে ধ্বংস করেন এবং সদকায় (যাকাত) সম্পদ বৃদ্ধি করেন। -সূরা বাকারা, আয়াত : ১৭৬
একমাত্র যাকাতই একটি রাষ্ট্র ও জাতিকে উপহার দিতে পারে একটি অনাবিল ও অনুপম জীবন ব্যবস্থা। তাই তো হযরত উসমান রাযি.-এর খেলাফতকালে দেশে কোনো অভাবি নাগরিক পাওয়া যায়নি। অথচ জাতি আজ পুঁজিবাদ আর সমাজবাদ ও গণতন্ত্রের বেড়াজালে পড়ে প্রতারিত হচ্ছে। প্রচারিত হচ্ছে সর্বত্রই সম্পদের জন্য জীবন, সম্পদেই মরণ আর সম্পদেই জীবন নির্বাহ। আত্মবিসর্জন নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে মানুষ যাকাত প্রদানে প্রদর্শন করছে চরম অবহেলা। অথচ অত্যন্ত জোরালো কণ্ঠে ঘোষিত হচ্ছে-

وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِّلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ

অর্থ : তাদের সম্পদে যাঞ্চাকারী বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে। -সূরা জারিয়াত, আয়াত : ১৯
সুতরাং গরিবের ওপর ধনীদের যাকাত প্রদান করুণা নয়, বরং তাদের অধিকার। কাজেই আমাদের করণীয় হলো যাকাতসহ ইসলামের যাবতীয় আহকাম ও নীতিমালার ব্যাপক প্রচার করা। জনসাধারণকে যাকাতের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে সচেতন করত, যাকাত প্রদানে উৎসাহিত করা। উপলব্ধি করতে হবে-

وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَا ٰتُوا الزَّكَاةَ.

অর্থ : তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং যাকাত আদায় করো। -সূরা বাকারা, আয়াত : ৪৩
এর ন্যায় অসংখ্য আহকাম। পাশাপাশি সিদ্দীকে আকবর রাযি.-এর ন্যায় ভূমিকা পালন করত, কঠোর হস্তে দমন করতে হবে কারুনের উত্তরসূরিদের যাবতীয় দৌরাত্ম। যাকাত আদায় না করার শাস্তি বর্ণনা করে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

مَنْ اَتَاهُ اللهُ مَالًا فَلَمْ يُؤَدِّ زَكوتَه مُثِّلَ لَه يَوْمَ الْقِيَامَةِ شُجَاعًا اَقْرَعَ لَه زَبِيْبَتَانِ وَ يَطُوَّقُه يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثُمَّ يَأْخُذُ بِلَهْزِمَتَيْهِ (يَعْنِىْ شَدْقَيْهِ) ثُمَّ يَقُوْلُ اَنَا مَالُكَ اَنَا كَنْزُكَ ثُمَّ تَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ يَبْخَلُوْنَ الاية ـ

অর্থ : যাকে আল্লাহ সম্পদশালী করেছেন, কিন্তু সে যাকাত আদায় করেনি, কেয়ামত দিবসে তার সম্পদকে (বিষের তীব্রতার কারণে) পশমবিহীন পিচ্ছিল মাথা ও চোখের ওপর দুই সাদা ফোটাবিশিষ্ট (যে সাপের এ দু’টি বৈশিষ্ট্য থাকে, সে সাপ অত্যন্ত বিষধর বলে গণ্য) বিষধর সাপের রূপ প্রদান করত, তার গলায় মালার আকারে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার দু’টি চোয়ালে কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি ধনাগার। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের উক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন। -বুখারী শরীফ

এমনিভাবে যাকাতের আহকাম প্রচলিত করার স্বার্থে যদি রাষ্ট্রে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন দেখা দেয় তবে সে কাজেও সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কায়েম করতে হবে খোদায়ী বিধান। তাহলেই হবে আজকের আলোচনা সার্থক। পরিশেষে কবি ফররুখ আহমেদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই-

আজকে উমরপন্থী পথির দিকে দিকে প্রয়োজন,
পিঠে বোঝা নিয়ে পাড়ি দিবে যারা প্রান্তর প্রাণপণ।
ঊষর মরুর অনাবাদী মাঠে ফলাবে ফসল যারা,
দিক দিগন্তে তাদেরে খুঁজিয়া ফিরিছে সর্বহারা।
মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।

আমাদের সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন।
সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube চ্যানেল Rahe Sunnat Media

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button