রোযা

 রমযানুল মোবারক : অফুরন্ত কল্যাণের ভাণ্ডার

 রমযানুল মোবারক : অফুরন্ত কল্যাণের ভাণ্ডার

 রমযানুল মোবারক : অফুরন্ত কল্যাণের ভাণ্ডার

اَلْحَمْدُ لِأَهْلِه وَالصَّلٰوةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى أَهْلِه أَمَّابَعْدُ! فَاَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ. یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَیْكُمُ الصِّیَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَی الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَۙ ۝۱۸۳
وَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. إِذَا دَخَلَ رَمَضَانَ فُتِحَتْ أَبْوَابُ الرَّحْمَةِ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ جَهَنَّمَ وَسُلِسَلَتِ الشَّيَاطِيْنَ

রমযানুল মোবারক : অফুরন্ত কল্যাণের ভাণ্ডার।
রমযানুল মোবারক : অফুরন্ত কল্যাণের ভাণ্ডার।
রহমত—বরকত, মাগফেরাত ও নাজাতের মহান সওগাত নিয়ে প্রতি বছর মাহে রমযান আমাদের মাঝে হাজির হয়। রমযান মূলত আল্লাহ্র পক্ষ থকে বান্দার প্রতি এক বিশেষ নিয়ামত। সৌভাগ্যের অধিকারী হওয়া, জীবনমান উন্নত করা, আত্মার পরিশুদ্ধি উত্তম নৈতিকচরিত্র গঠন এবং নির্মল, পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর সমাজ গঠন করা এ মাসের অনুশীলনের মাধ্যমে সম্ভব।

আমরা সবাই জানি, রমযান মাসে মহাগ্রন্থ আল—কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এটি শুধু কুরআন নাজিলের মাসই নয়; বরং সকল আসমানী কিতাব এ মাসেই অবতীর্ণ হয়েছে। কুরআন ও অন্যান্য আসমানী কিতাব নাজিলের জন্যই রমযান কল্যাণের আঁধারে পরিণত হয়েছে। সুতরাং রমযান যথাযথভাবে, গুরুত্ব¡সহকারে পালন করতে হবে এবং আমলের লাইনে খুব মুজাহাদা করতে হবে।

মাহে রমযানে মুসলিম উম্মাহর অন্যতম দায়িত্ব হলো, দিনের বেলা রোযা রাখা। এ মাসে যে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, তা সমগ্র মানব জাতির সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য। কিন্তু এ কুরআন থেকে সঠিক পথের দিশা পেতে হলে কিছু যোগ্যতা ও গুণাবলির প্রয়োজন। যেমন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, এটা সেই কিতাব যাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটা মুত্তাকীদের জন্য পথপ্রদর্শক, যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনে, নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। যারা ঈমান আনে তোমার এবং তোমার পূর্ববর্তী নবীদের প্রতি অবতীর্ণ কিতাবের প্রতি, আর নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে আখেরাতের প্রতি। -সূরা বাকারা— আয়াত : ২/৪

তাকওয়ার সাথে উল্লিখিত গুণাবলি, সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে। এজন্য মুসলমানদেরকে কুরআন থেকে হেদায়াত লাভের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআন নাজিলের এ মাসে রোজাকে ফরয করে তার উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। সুতরাং রমযানের সকল নিয়মাবলি যথাযথভাবে পালন করে, কাঙ্ক্ষিত গুণাবলি নিজের মধ্যে তৈরি করে কুরআন থেকে হেদায়াত লাভের যোগ্য করে গড়ে তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। এ রোযা শুধু আমাদের ওপর নয়, বরং অতীতের সকল নবী আলাইহিস সালাম ও উম্মতের ওপর ফরয ছিল। আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন, হযরত আদম আলাইহিস সালামের সময় থেকে হযরত নূহ আলাইহিস সালামের যামানা পর্যন্ত, প্রতি মাসে তিনটি রোযা ফরয ছিল। হযরত নূহ আলাইহিস সালাম থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সকল উম্মতের জন্য রমাযান মাসে রোযা ফরয করা হয়েছে।

কুরআন যে জীবনাদর্শ ও জীবনব্যবস্থা উপস্থাপন করে তা প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপালনের জন্য এক দল আল্লাহ্ভীরু, সৎ ও সত্যনিষ্ঠ লোকের প্রয়োজন। যারা একমাত্র আল্লাহর ভয় ও আখেরাতের জবাবদিহিতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, সকল প্রকার অন্যায়—অনাচার লোভ—লালসা, অনুরাগ—বিরাগের ঊর্ধ্বে থেকে সার্বিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করবে। সমাজ ও জনগণের কল্যাণই হবে যাদের ব্রত। রোযার উদ্দেশ্য সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করে হয়েছে, যেমন তা ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার।’ -সূরা বাকারা— আয়াত : ১৮৩

মুত্তাকী বলা হয় তাদেরকে যারা আখেরাতের জন্য ক্ষতিকর সকল কথা, কাজ ও চিন্তা সম্পূর্ণভাবে বর্জন করে চলে। অর্থাৎ, দুর্নীতিমুক্ত কর্তব্যপরায়ণ সুনাগরিকই হলেন মুত্তাকী। কুরআন উপস্থাপিত কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য এ ধরনের মুত্তাকী নাগরিক একান্ত প্রয়োজন। এ জন্য কুরআন নাজিলের এ মাসে রোযা ফরয করে দিয়ে মুত্তাকী বানানোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুতরাং আমরা যদি খাঁটি তাকওয়া অর্জন করতে পারি, তাহলে আমাদের জীবনের প্রতিটি কর্মকাণ্ড চলন—বলন, আচরণ—উচ্চারণ সবকিছু হবে গুনাহমুক্ত ও সুন্দর।

ধৈর্য ও আত্মসংযম মানুষের সফলতা ও নিয়ন্ত্রিত জীবন—যাপনের চাবিকাঠি। রোযা সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযাদারকে পানাহার থেকে বিরত রাখে। এর ফলে ক্ষুধা, পিপাসায় চরম কষ্টের সময়েও তাকে সেগুলো বর্জন করে আত্মসংযম ও ধৈর্যধারণ করতে হয়। এভাবে দীর্ঘ এক মাস অনুশীলনের ফলে, ভোগ—বিলাসের প্রতি তার লোভ—লালসা হ্রাস পায় এবং সে আত্মসংযমে অভ্যস্ত হয়। কঠিন ক্ষুধার সময় যে কষ্ট অনুভব হয়, তা সহ্য করার মাধ্যমে সে ধৈর্যশীল ব্যক্তিতে পরিণত হয়। এর ফলে সে অন্য যে কোনো কঠিন পরিস্থিতি ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করার প্রশিক্ষণ পায়। এ জন্যই হাদীস পাকে বলা হয়েছে, এ মাস হলো ধৈর্যের মাস, আর ধৈর্যের বিনিময় হলো জান্নাত। -মিশকাত

হাদীসে রমযানকে সমবেদনা ও সহমর্মিতার মাস হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সমাজে দরিদ্রশ্রেণির লোকেরা অনাহারে অর্ধাহারে থেকে ক্ষুধায় যে কষ্ট পায়, ধনী ব্যক্তিরা তা যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারে না। কিন্তু রমযান মাসে রোযা পালন করতে গিয়ে দীর্ঘ সময় উপবাস থাকার কারণে ক্ষুধার যে কী যন্ত্রণা, তা তারা উপলব্ধি করতে পারে।

এর ফলে তাদের মধ্যে ক্ষুধার্ত ব্যক্তিদের প্রতি অনুকম্পা ও সহমর্মিতার অনুভূতি জাগ্রত হয় এবং সমবেদনায় সিক্ত হয়ে, তারা তখন দরিদ্রদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। রোযার মাধ্যমে এ অনুভূতি যদি সকল ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে জাগ্রত করা যায়, তাহলে তা দারিদ্র্যবিমোচনে সহযোগী ভূমিকা পালন করবে। এ মাসে বেশি বেশি দান করা, রোযাদারকে ইফতার করানো ও পরিতৃপ্তি সহকারে খাদ্য খাওয়ানো এবং অধীনস্ত ব্যক্তিদের কাজের ভার লাঘব করে দিতে হাদীসে বলা হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে পারস্পরিক মায়া—মমতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও সমবেদনার পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা একটি সুন্দর সমাজের জন্য খুবই জরুরি।

রমযানকে যথাযথভাবে প্রতিপালনের মাধ্যমে অতীতের ভুলত্রুটি পরিমার্জনের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ হওয়া যায়। হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহ্তেসাবের সাথে রোযা পালন করে, তার অতীতের গুনাহগুলো মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহ্তেসাবের সাথে রমজানের রাত্রি জাগরণ করে, তার অতীতের গুনাহগুলো মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহ্তেসাবের সাথে লাইলাতুল কদর জাগরণ করে তারও অতীতের গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়। -বুখারি ও মুসলিম

বরকত ও কল্যাণের বার্তাবাহক রমযান মাস। হাদীসে বলা হয়েছে, এ মাসের প্রথম দশক রহমতের, মধ্য দশক মাগফেরাতের এবং শেষ দশক জাহান্নাম থেকে নাজাতের। এ মাসে কেউ নফল ইবাদত করলে অন্য মাসের ফরযের সমতুল্য সওয়াব পাবে। এ মাসে ১টি ফরয আদায় করলে অন্য মাসে ৭০টি ফরয আদায়ের সওয়াব পাবে। এ মাসে কোনো রোযাদারকে ইফতার করালে সেটা গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে নাজাতের কারণ হবে এবং উক্ত রোযাদারের সমপরিমাণ সওয়াব ইফতার যিনি করান তার আমলনামায় লিখে দেয়া হবে। অথচ রোযাদারদের সওয়াবের কোনো কমতি হবে না। -মিশকাত

হাদীস শরীফে আরো এসেছে, প্রতিটি মানুষের ভালো কর্মের বদলা দশ থেকে সাতশতগুণ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। কিন্তু রোযা এর ব্যতিক্রম। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, রোযা খাছ করে আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব। -বুখারী ও মুসলিম

অন্য হাদীসে এসেছে, রোযা এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে আল্লাহ্! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও কামনা—বাসনা থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করো। আর কুরআন পাক বলবে, হে আল্লাহ্ আমি তাকে রাত্রির ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। এ দুটি সুপারিশই গ্রহণ করা হবে। -মিশকাত

এ মাসে লাইলাতুল কদর নামে একটি রাত্র রয়েছে, যার ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাত্রিতে ফেরেশতা ও রূহ তথা জিবরাইল আলাইহিস সালাম মহান আল্লাহর অনুমতিক্রমে তার গুরুত্ব¡পূর্ণ নির্দেশাবলি নিয়ে অবতরণ করে। ফজর উদয় হওয়া অবধি এ রাত্রিতে শান্তি বর্ষিত হতে থাকে। -সূরা কদর— আয়াত ৩/৫

রমযান মূলত সওয়াব অর্জনের এক বিশেষ মৌসুম। নিজের আমল ও চেষ্টা—প্রচেষ্টার দ্বারা এ মাসে যে যতো বেশি অর্জন করতে পারবে, সে তত বেশি কল্যাণের অধিকারী হবে। এ মাসে রোযাপালন, রাত্রি জাগরণ ইত্যাদি ছাড়াও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি কাজ বেশি করতেন। তা হলো কুরআন তেলাওয়াত ও বেশি বেশি করে দান করা। আমরাও যদি অন্যান্য আমলের পাশাপাশি এ দুটি কাজ বেশি করি, তাহলে বেশি কল্যাণ লাভ করতে পারব।

অন্য এক হাদীসে রমযান মাসে আরও চারটি বিশেষ আমলের কথা বলা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রমযান মাসে তোমরা চারটা আমল বেশি বেশি করবে। দুটি আমল, এমন যাতে আল্লাহ্ তা’আলা সন্তুষ্ট হন। আর দুটি আমল এমন যা না করে তোমাদের কোনো উপায় নেই। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে দুটি আমলে আল্লাহ্পাক সন্তুষ্ট হন তা হলো, লা—ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়া এবং বেশি বেশি আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার তথা ক্ষমা চাওয়া। আর যে দুটি আমল না করে তোমাদের কোনো উপায় নেই, তা হচ্ছে মহান আল্লাহর কাছে জান্নাত কামনা করা এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাওয়া।

আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

نَصْرٌ مِّنَ اللهِ وَ فَتْحٌ قَرِيْبٌ

আমাদের সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন।
সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube চ্যানেল Rahe Sunnat Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button