ইবাদতহজ্ব

হজ জিলহজ মাসের অন্যতম আমল। ইসলামের আলোকে হজ।

হজ জিলহজ মাসের অন্যতম আমল। ইসলামের আলোকে হজ।

হজ জিলহজ মাসের অন্যতম আমল। ইসলামের আলোকে হজ।

হজ ইসলামের পাঁচটি বুনিয়াদী বিষয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নবম হিজরীতে হজ ফরয হয়। যে ব্যক্তির কাছে হজ যাওয়ার মতো যান-বাহনের ব্যবস্থা থাকে এবং ফিরে আসার সমস্ত ব্যয়ভার এবং এর মধ্যবর্তী সময়ে সংসারের ব্যয়ভার বহনের যোগ্যতার অধিকারী হয় তার ওপর হজ ফরয। যিলহজ মাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হচ্ছে হজ। হজ হচ্ছে, মুসলমানদের বিশ্বসম্মেলন। ইসলামে হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। বৈষয়িক দিক দিয়েও হজের উপকারিতা সীমাহীন।

হজ কি? বিশেষ কিছু স্থান বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে মহান আল্লাহর দরবারে তার পাগল বান্দাদের উপস্থিত হওয়া এবং হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কর্মকা- ও ক্রিয়া-পদ্ধতির পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে তার সাথে নিজের একাত্মতা প্রকাশ করা। আপন সামর্থ্য অনুযায়ী হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের আবেগ উচ্ছ্বাসে অংশগ্রহণ করা এবং সেই রঙে নিজেকে রঙিন করা।

হজের বিষয়টি ইশক ও মহব্বতের বিষয়। মানুষ নামাজ, রোযা, যাকাত ইত্যাদি আল্লাহর হুকুম পালন করার পর যখন আল্লাহর প্রেমে পাগলপারা হয়ে যায়, তখন প্রকৃত খোদার নিদর্শনের খোঁজে বাইতুল্লাহ পৌঁছে যায়, পাগলের মতো সেলাইবিহীন কাপড় পরে মস্তক অনাবৃত রেখে বাইতুল্লাহর চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করে তার মাশুককে খুঁজতে। এমনি করে চুল নখ না কাটা, চুল-দাড়িতে চিরুনি ব্যবহার না করা, তেল মালিশ না করা। সুগন্ধি ব্যবহার না করা, স্বরবে আলোড়িত করে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। আমি হাজির, আমি উপস্থিত বলে ধ্বনি করা, বাইতুল্লাহর চারপাশ প্রদক্ষিণ করা, আল্লাহর ঘরের একপাশে স্থাপিত কালো পাথর ‘হাজরে আসওয়াদ’ চুম্বন করা। কাবার দরজা ও প্রাচীর ধরে কান্নাকাটি করা, এরপর সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে ছুটাছুটি করা। তারপর মক্কা শহর ছেড়ে কখনো মিনায় কখনো আরাফায়, কখনে বা মুযদালিফার প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানো। অতঃপর জামরাতে বারবার কংকর নিক্ষেপ করা। এ কাজগুলো প্রেমের পাগলরা করে থাকে।
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম প্রেমিকদের এ প্রেমপ্রথার প্রবর্তক। তাঁর এ কাজগুলো আল্লাহর নিকট এত পছন্দ হয়েছে, তাঁর দরবারে বিশেষ হাজিরার সময় ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। এসব কর্মকা-ের সমষ্টিগত নামই হজ। আর এটাই ইসলামের সর্বশেষ ও চূড়ান্ত রুকন।

হজ ফরয হয়েছে ৯ম হিজরীতে। এরপরের বছর ১০ম হিজরীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকালের মাত্র তিন মাস পূর্বে বিপুলসংখ্যক সাহাবায়ে কেরামদের সাথে নিয়ে হজ পালন করেন। ইতিহাসের পাতায় একে বিদায় হজ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
এই বিদায় হজে ইসলামের একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। যেমন ইরশাদ হচ্ছে-

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا .

অর্থ : আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দীন পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নেয়ামত চূড়ান্ত করলাম এবং আমি তোমাদের জন্য ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ দীন হিসাবে মনোনীত করলাম।
-সূরা মায়েদা, আয়াত : ৩

এ হজ যে ইসলামের শেষ গুরুত্বপূর্ণ রুকন ও আয়াতে সে দিকে সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে। যারা সুষ্ঠুভাবে হজ সম্পাদন করবেন তাদের জন্য রয়েছে প্রচুর সুসংবাদ। যেমন ইরশাদ হচ্ছে-

عَنْ اِبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلّٰى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَلْعُمْرَةُ اِلٰى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِّمَا بَيْنَهُمَا وَالْحَجُّ الْمَبْرُوْرُ لَيْسَ لَه جَزَاءٌ اِلَّا الْجَنَّةُ ـ

অর্থ : হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘এক উমরাহ থেকে আরেক উমরাহ মধ্যবর্তী গুনাহের কাফ্ফারা। মকবুল হজের প্রতিদান তো কেবল জান্নাত।’-বুখারী ও মুসলিম
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত-

مَنْ حَجَّ لِلّٰهِ فَلَمْ يَرْفَثْ وَ لَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمٍ وَلَدَتْهُ اُمُّه ـ

অর্থ : নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই হজ করে এবং তাতে কোনো অশ্লীল কথা না বলে কিংবা অশ্লীল কার্য না করে, তা হলে সে হজ থেকে এমন বে-গুনাহ হয়ে ফিরবে যেমন আজই তার মা তাকে প্রসব করেছে। -বুখারী, মুসলিম ও মেশকাত
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেছেন-

تَابِعُوْا بَيْنَ الْحَجِّ وَ الْعُمْرَةِ فَاِنَّهُمَا يَنْفِيَانِ اَلْفَقْرَ وَالذُّنُوْبَ ـ

অর্থ : তোমরা লাগাতার হজ ও ওমরাহ করতে থাকো। এই হজ ওমরাহ তো তোমাদের দারিদ্র্য ও পাপ মোচন করবে।
-তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ
দুনিয়াতে এ রকম বহু আল্লাহর বান্দা আছেন যারা প্রতি বছর হজ করেন, ওমরাহও করেন। আলহামদুলিল্লাহ, প্রতি বছর তাদের অর্থের ব্যবস্থা হয়ে যায় তাদের অভাব বাড়ে না বরং কমে। তাদের টাকা পয়সা কমে না; বরং বাড়ে। ইরশাদ হচ্ছে-

عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ اَلْعُمْرَةُ اِلٰى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِّمَا بَيْنَهُمَا وَالْحَجُّ الْمَبْرُوْرُ لَيْسَ لَه جَزَاءٌ اِلَّا الْجَنَّةُ ـ

অর্থ : হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং বলেছেন, এক ওমরা করার পর আর এক ওমরা করা পর্যন্ত যত গুনাহ হয়, তা মাফ হয়ে যায়। আর মাকবুল হজের বদলা তো কেবল জান্নাত। -বুখারী ও মুসলিম
মাআরেফুল হাদীস গ্রন্থে আল্লামা মঞ্জুর নোমানী রহ. লিখেছেন, যে ব্যক্তি নিষ্ঠার সাথে হজ কিংবা ওমরা পালন করে, সে যেন আল্লাহর রহমতের সমুদ্রে ডুব দিয়ে গোসল করে। ফলে সে গুনাহের পঙ্কিলতা থেকে পাক পরিষ্কার হয়ে যায়। এছাড়া আল্লাহর অনুগ্রহে সে দুনিয়ার জীবনে দারিদ্র্য অভাব, অভিযোগ ও দুশ্চিন্তা থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন লাভ করে। ওপরন্তু হজে মাবরুরের পুরস্কারস্বরূপ জান্নাত তার জন্যে নিশ্চিত। এ ছাড়া হাজী সাহেবদের অনেক ফযিলত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। যা স্বল্প পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয়।

হজ ফরয হওয়ার যেমনিভাবে মহান আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন তেমনিভাবে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ ফরয হওয়ার দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। যেমন ইরশাদ হচ্ছে-

وَلِلّٰهِ عَلٰى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا ۚ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ اللّٰهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِيْنَ ـ

অর্থ : আল্লাহর আদেশ পালনার্থে হজ করা ফরয। ঐসব লোকের ওপরে যারা সে পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম। আর যারা মানবে না তারা আল্লাহর কোনো ক্ষতিও করতে পারবে না। আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টিকুলের মধ্যে কাউকেই পরোয়া করেন না। -আলে-ইমরান, আয়াত : ৯৭
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষণ দান করেন। সে ভাষণে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ ফরয হওয়ার ব্যাপারে আমাদের বললেন-

يَا اَيُّهَا النَّاسُ! قَدْ فُرِضَ عَلَيْكُمُ الْحَجُّ فَحُجُّوْا فَقَالَ رَجُلٌ اَكُلُّ عَامٍ يَارَسُوْلَ اللهِ الخ

অর্থ : হে মানব-লী! তোমাদের ওপর হজ ফরয করা হয়েছে। অতএব, এখন থেকে তোমরা হজ আদায়ের চিন্তা-ভাবনা করো। এক ব্যক্তি বলল প্রত্যেক বছরই কি হজ ফরয? -মুসলিম শরীফ
হযরত আলী রাযি. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

مَنْ مَلَكَ زَادً اَوْ رَاحِلَةً تُبَلِّغُه اِلٰى بَيْتِ اللهِ وَلَمْ يَحُجُّ فَلَا عَلَيْهِ اَنْ يَمُوْتَ اِنْ شَاءَ يَهُوْدِيًّا وَّ اِنْ شَاءَ نَصْرَابِيًّا ـ وَذٰلِكَ اِنَّ اللهَ تَبَارَكَ وَ تَعَالٰى يَقُوْلُ وَلِلّٰهِ عَلٰى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ اِلَيْهِ سَبِيْلًا ـ

অর্থ : যে ব্যক্তির হজে যাওয়ার মতো সম্বল থাকে এবং যান-বাহনের ব্যবস্থা থাকে যাতে করে সে বায়তুল্লাহ শরীফে পৌঁছতে পারে, এরপর যদি সে হজ না করে তবে সে ইহুদি হয়ে মারা যাক; কি নাসারা হয়ে মারা যাক, তাতে কিছু যায় আসে না। এটা এ কারণে, আল্লাহ বলেন, বাইতুল্লাহর হজ করা আল্লাহর জন্য সেই সব লোকের ওপর ফরয, যারা সে পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম। -তিরমিযী শরীফ
এ সতর্কীকরণ বাক্যটি ঠিক তেমন, যেমন সালাত তরক করার ব্যাপারে ইরশাদ হচ্ছে-

وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ-.

অর্থ : তোমরা সালাত কায়েম কর এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। -সূরা রুম, আয়াত : ৩১
হজ ফরয হওয়া সত্ত্বেও যারা তা পালন করে না, তাদেরকে মুশরিকদের পরিবর্তে ইহুদি-নাসারাদের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এর কারণ হলো তৎকালীন সময়ে হজ না করা ছিল ইহুদি-নাসারাদের বৈশিষ্ট্য। আরবের মুশরিকরা হজ করত; কিন্তু তারা নামাজ পড়ত না। এ কারণে নামাজ না পড়াকে মুশরিকসুলভ আচরণ বলা হয়েছে।

আরো একটি কথা বলে যেতে চাই, হজের মধ্যে আবদিয়্যাত ও খেলাফত, মানুষের এ উভয়বিধ সম্পর্কের চরম ও পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটে। একদিকে যেমন বান্দা হিসাবে আল্লাহর প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে তাঁরই আনুগত্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে কোনো প্রশ্ন তোলে না। সে ঘুরে বেড়ায় কা’বার চারপাশে। কুরবানি দেয় সকল পাশবিকতা। এমনিভাবে সে তার খেলাফতের দায়িত্ব উপলব্ধি করার জন্য আরাফার ময়দানে শামিল হয় মুসলিম উম্মাহর বিশ্বসম্মেলনে। সেখানে কোনো ভেদাভেদ থাকে না। নিতে পারে সমস্যাসমূহের সমাধান।

তাই যাদের ওপর হজ ফরয হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

وَاَتِمُّوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَۃَ لِلّٰهِ

অর্থ : তোমরা আল্লাহর উদ্দেশে হজ এবং ওমরা পরিপূর্ণভাবে পালন করো। -সূরা বাকারা, আয়াত : ১৯৬
কুরআনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সময় ক্ষেপণ না করে দ্রুত হজ করে আসুন। আল্লাহর হুকুম পালন করুন। অজুহাত সৃষ্টি না করে নিজের মুক্তির জন্য যৌবন কালেই হজ পালন করুন। ছেলে-মেয়ের বিবাহ বাকি আছে এই অজুহাত আল্লাহর কাছে চলবে না। হজ সময় থাকতেই করা দরকার। শক্তি-সামর্থ্য থাকতেই করা দরকার।

হজের নিয়ত হবে সম্পূর্ণ খালেস। কোনো রকম ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ত বা দেশ ঘুরার নিয়ত থাকলে চলবে না। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করতে হবে। কেউ মনে করে আছেন একটি জমি কিনতে হবে, হজ করি কিভাবে। এভাবে জমি কিনতে বাড়ি করতে টাকা শেষ হয়ে যায়। তারপর হজ করা হয় না। আল্লাহ তাআলা আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। সব রকম ভুল ধারণা থেকে মুক্ত করুন। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে হজ করার তাওফীক দান করুন। পরিশেষে কবির ভাষায় বলতে চাই-

ওরে, ওরে, মুসলিম মোরা ভাই ভাই,
হজ করিতে চল মক্কা শরীফ যাই।
মোদের এ হজ যেন হয় না কোনো পণ্য,
হজ করে মোরা সবে হয়ে যাব ধন্য।

আমাদের সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন।
সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube চ্যানেল Rahe Sunnat Media

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button